
বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি ভারতকে পাঠিয়েছে এবং প্রয়োজনে একটি অনুস্মারক পাঠানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম। তাকে উদ্ধৃত করে বিষয়টি জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে হাসিনার প্রত্যার্পণের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া ও এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে সংবাদ মাধ্যমটি। সেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশ ভারতকে একটি নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক নোট) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনুরোধ জানালেও এখন পর্যন্ত ভারত কোনো উত্তর দেয়নি। নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো সংযত অবস্থান বজায় রেখেছে এবং বারবার অনুসন্ধান করা হলেও তারা প্রাথমিক স্বীকৃতির বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০১৬ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়ার আইনি অধিকার রাখে। তবে এই চুক্তি কার্যকর করা শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত যদি এই প্রত্যর্পণ অনুরোধ মেনে নেয়, তবে এটি একাধিক ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে, যেখানে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির বিধান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির বাস্তবতা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে অনুরোধ পাঠাতে হয়, যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর বিস্তারিত বিবরণসহ প্রমাণাদি সংযুক্ত থাকতে হবে। এর মধ্যে বিচারিক আদেশ, গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথিপত্র অন্তর্ভুক্ত থাকতে হয়।
ড. তাক আরও বলেন, ‘এই অনুরোধের সঙ্গে বাংলাদেশকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, শেখ হাসিনার বিচার ন্যায্য হবে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে না।’
অর্থাৎ, শুধুমাত্র অভিযোগের বিবরণ পাঠানোই যথেষ্ট নয়; বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে, শেখ হাসিনার বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবিত হবে না। ভারত এই বিষয়টি যাচাই না করা পর্যন্ত প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নাও যেতে পারে।
ড. তাক ব্যাখ্যা করেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যেহেতু প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, ভারতীয় সরকার নিশ্চিত করবে যে, প্রত্যর্পণের শর্তাবলী যথাযথভাবে মানা হচ্ছে কি না।’
এটি পর্যালোচনার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে ডুয়াল ক্রিমিনালিটি। অর্থাৎ, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো উভয় দেশেই অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত কি না। একইসঙ্গে, ভারতকে দেখতে হবে যে, অভিযোগগুলো রাজনৈতিক, সামরিক বা ধর্মীয় অপরাধের আওতায় পরে কি না—যা প্রত্যর্পণ বাতিলের কারণ হতে পারে।
এমনকি প্রশাসনিক পর্যালোচনার পরেও বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। প্রত্যর্পণ অনুরোধের আইনি বৈধতা ভারতের বিশেষ প্রত্যর্পণ আদালতে খতিয়ে দেখা হবে।
ড. তাক বলেন, ‘ভারত প্রত্যর্পণের বিষয়ে বিচারিক পর্যালোচনাও করবে। বিশেষ আদালত এটি বিশ্লেষণ করবে এবং যদি দেখা যায় যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার করা হতে পারে, তবে আদালত প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া স্থগিত করতে পারে।’
এই বিচারিক পর্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নিশ্চিত করে যে, রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের জন্য প্রত্যর্পণ আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
ড. তাক বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা হবে, যতক্ষণ না প্রত্যর্পণের আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়।’
তার রাজনৈতিক অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে, এই বন্দিত্ব কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হতে পারে, যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা বা পালানোর আশঙ্কা না থাকে।
প্রত্যর্পণের শেষ ধাপ হবে শেখ হাসিনাকে ভারতীয় হেফাজত থেকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা। এটি একটি সাবধানে সমন্বয়কৃত প্রক্রিয়া হবে, যেখানে আইনি ও কূটনৈতিক সব নিয়ম মেনে চলতে হবে।
ড. তাক বলেন, ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে ভারতীয় হেফাজত থেকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বা সীমান্ত পয়েন্টে সম্পন্ন হয়।’
প্রচলিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী, এটি হয় কোনো সরকারি চার্টার্ড বিমানের মাধ্যমে, যা দিল্লি বা কলকাতা থেকে ঢাকা যাবে, অথবা পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত পয়েন্টে হস্তান্তর করা হতে পারে।
ড. তাক বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট সুরক্ষা ও ইমিউনিটি দেওয়া হয়, যা প্রত্যর্পণকে আরও জটিল করে তোলে।’
এছাড়া, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং দাবি তুলতে পারে যে, শেখ হাসিনা দেশে ফিরে নিরপেক্ষ বিচার পাবেন না, বরং রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হবেন।
শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও নতুন কৌশল নেওয়া হতে পারে। তিনি ভারতের কাছ থেকে আশ্রয় চাওয়ার আবেদন করতে পারেন, যা প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তুলবে।
এদিকে, বাংলাদেশ সরকার প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকলেও, ভারত সরকার এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। ভারত যদি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি বড় কূটনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। আবার, প্রত্যর্পণের অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করাও নয়াদিল্লির জন্য সহজ সিদ্ধান্ত হবে না। তাই হাসিনাকে নিয়ে মোদি সরকার এখন বেকায়দায় রয়েছে। অনেকটা শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশায়।
তাই, এই মুহূর্তে ভারত কৌশলগতভাবে নীরবতা বজায় রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আপাতত, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।