Image description

একপাশে ভেঙে পড়ে আছে বিশালাকৃতির কৃষ্ণচূড়া গাছ, ময়লা আবর্জনার স্তূপ, বিভিন্ন জায়গায় ভাঙা সীমানা প্রাচীর। নেই 'গণভবন' লেখা নেমপ্লেটও। নতুন কাউকে না বলে দিলে চিনতেও পারবে না এই ভবনেই গত ১৫ বছর থেকেছেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটি।

দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা চার-পাঁচবারের চেষ্টায় প্রধান ফটকের তালা খুললেন। অথচ ছয় মাস আগেও এসএসএফ সদস্যরা এখানে উদ্যত রাইফেল তাক করে থাকত সবসময়।

ভেতরে ঢোকার রাস্তায় আবর্জনা, গাছের ঝরা পাতা সহজেই বোঝাবে এই রাস্তায় এখন মানুষ চলাচল করে না। প্রথমেই চোখে পড়বে কয়েকটি ঘাস-কাটার মেশিন। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার ফল স্পষ্ট, সবখানেই লম্বা ঘাস। আরও কয়েক কদম এগোলে কয়েকটি ভাঙা গাড়ি, যা ৫ আগস্ট মানুষের ক্ষোভ বা বিজয়ের স্মৃতি বহন করে চলেছে।

গণভবনের মূলভবনে প্রবেশের পথেই পড়ে আছে কাঠের ভারী আসবাবপত্র ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র। তার ওপর ধুলোর পুরু স্তুর। দেখে মনে হয়, কেউ যেন বিক্রির জন্য পুরোনো আসবাব ফেলে রেখেছে। বিশাল এই আসবাবগুলো এতই ভারী যে হয়তো গত ৫ আগস্ট সেগুলো নিতে পারেনি বিক্ষুব্ধ জনতা।

ভেতরে প্রবেশের পর প্রথমেই বড় হলঘর। সেখানেই সংবাদ সম্মেলন করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ঘরে করা সংবাদ সম্মেলনেই তিনি আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের 'রাজাকার' আখ্যা দিয়েছিলেন, মূলত যার মাধ্যমে সূচনা হয়েছিল তার পতনের।

গণভবনের মূলভবনে প্রবেশের পথেই পড়ে আছে কাঠের ভারী আসবাবপত্র ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র। ছবি: স্টার

শেখ হাসিনাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিতেন যারা এবং তার পক্ষের সাংবাদিকরাই কেবল ওই কক্ষে প্রবেশের অনুমতি পেতেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদকর্মীদের গণভবনে প্রবেশ কিংবা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কোনো কর্মসূচি কাভার করতে দেওয়া হয়নি এবং এর জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যাও কখনো দেওয়া হয়নি।

 

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাস পর এখন গণভবনের ভেতরের ফাঁকা দেয়ালগুলোতে এমন সব গ্রাফিতি, যেগুলো তার সময়কালে থাকলে তা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো।

শেখ হাসিনা গণভবনের যে অংশ বসবাস বা অফিস করার জন্য ব্যবহার করতেন, সেগুলোর দেয়াল ছিল বুলেটপ্রুফ। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা সেসব দেয়ালের প্লাস্টার তুলে ফেলে, যেখান থেকে এখন উঁকি দিচ্ছে কংক্রিট।

একাধিকবার হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন যে, তার আওয়ামী লীগ সরকার 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯' পাস করে, যার আওতায় তিনি ও তার পরিবার রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা পেত।

গণভবনের আক্ষরিক অর্থ 'জনগণের ভবন'। অথচ এই ভবনে থেকেই তিনি শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়েছিলেন জনবিচ্ছিন্ন। যার ভয়ে এত সুরক্ষাবলয়, সেই বুলেট নয়, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।

 

৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা দেয়ালের প্লাস্টার তুলে ফেলে। ছবি: স্টার

অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশাল এই বাড়ির করিডরগুলো এখন অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। সেখানে হাঁটতে গেলেও ঝুঁকি। কারণ সব ঘরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো। অনেক কক্ষের সিলিংয়ে এখনো ঝুলছে ভাঙা ঝাড়বাতির অংশবিশেষ। কাঁচভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে দিনে সূর্যের আলো ঢোকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানেও বাড়তে থাকে অন্ধকার।

পৌনে তিন একর জায়গাজুড়ে নির্মিত গণভবন ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক নির্মাণের পর থেকে শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী সেখানে বসবাস করেননি।

বেগম খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন সেনানিবাসের বাসভবন ব্যবহার করেছেন।

২০০১ সালে শেখ হাসিনা সরকার টোকেন এক টাকার বিনিময়ে এই বাড়িটি ইজারা দিয়েছিল তার নামে। ২০০১ সালে নিজের ক্ষমতা শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে 'জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯' এর আওতায় এই ইজারা দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে আসার পরও শেখ হাসিনা এই বাড়িতেই ছিলেন। বিরোধী দলের প্রবল চাপের মুখে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট তিনি গণভবন ত্যাগ করেন।

শেখ হাসিনা অনেকবার অভিযোগ করেছিলেন যে, সেই সময় গণভবনের বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

 

অনেক কক্ষের সিলিংয়ে এখনো ঝুলছে ভাঙা ঝাড়বাতির অংশবিশেষ। ছবি: স্টার

গণভবনে ঘরগুলোতে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে ধুলোর পুরু স্তর, পশুর মলমূত্র, মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাঙা কাচের টুকরো, মাকড়সার জাল।

গণভবনে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা নথিপত্র দেখে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা জন্মে, যিনি তার শাসনামলে পরিণত হয়েছিলেন এক স্বৈরশাসকে।

'অতি গোপনীয়' লেখা নথিগুলো গণভবনের মেঝের এখানে-সেখানে পড়ে থাকতে দেখে মাথায় চলে আসে রবীন্দ্রনাথের গান—'গোপন কথাটি রবে না গোপনে...'

এই নথিপত্র থেকে জানা যায়, গণভবনের শেষ দিনগুলোতে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন নস্যাৎ করার নানান পরিকল্পনা করছিলেন।

তার শয়নকক্ষে পাওয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার নথিতে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মোকাবিলায় ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।

গণভবনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নথি। ছবি: স্টার

ওই কর্মপরিকল্পনার নয় নম্বর পয়েন্টে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্র সমন্বয়কারীদের দ্রুত বিচার আইনে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

একটি পয়েন্টে সুপারিশ করা হয়েছে, 'অপরাধের তীব্রতা বিবেচনায় ডিবি (গোয়েন্দা শাখা) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং গণগ্রেপ্তারে আটক সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।'

সুপারিশ দেখে এটা স্পষ্ট যে, নথিটি জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের, যখন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদসহ ছয় সমন্বয়কারী ডিবি হেফাজতে ছিলেন।

তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো মন্ত্রীকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদনে।

সার্বিক সংকট মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মো. আকবর হোসেনকে সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশও করা হয়।

গণভবনের ভেতরে পড়ে থাকা ভাঙা গাড়ি। ছবি: স্টার

এ বছরের ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) আকবরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

নথিতে সরকারকে 'কঠোর নজরদারি' জোরদার করা এবং বিভিন্ন পেজ ও প্রোফাইল থেকে ছড়ানো 'আপত্তিকর' কনটেন্ট সরিয়ে ফেলা ও ব্লক করারও সুপারিশ করা হয়েছে।

আন্দোলনে অর্থায়নে ব্যবহৃত হুন্ডি নেটওয়ার্ক বন্ধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) নির্দেশ দিতেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করা হয়।

ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা আরেকটি নথিতে ছয়জনের একটি তালিকা রয়েছে, যাদের 'অর্থদাতা ও উসকানিদাতা' হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। তালিকায় থাকা দুই ব্যাংক-প্রধান, একজন ব্যবসায়ী ও এক ব্যক্তিকে 'তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বন্ধু' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মনিরুল তখন পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ শাখা বা এসবির প্রধান ছিলেন।

ওই নথিতে থাকা আরও দুজনের নামে চোখ আটকে যেতে পারে। তারা হলেন—সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ এবং তারকা ক্রিকেটার ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান। নথিতে এই দুজনের বিরুদ্ধে গোপনীয়তার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন না কাটার ফলে বেড়ে ওঠা ঘাস। ছবি: স্টার

নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়, 'তারেক জিয়ার নির্দেশে' ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের উত্তরা শাখা আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।

শেখ হাসিনার শয়নকক্ষের এক কোণে দেখা যায়, মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে ইসলাম কী বলে, সেই লেখা-সম্বলিত একটি কাগজ।

মার্কারি কলম দিয়ে মার্ক করা সেই কাগজে একটি লাইনে লেখা ছিল, 'জগতে বিপর্যয় সৃষ্টি বা হত্যার শাস্তি ব্যতিরেকে যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।' অন্য একটি লাইনে বলা হয়েছে, 'মহানবী (সা.) মানুষ হত্যাকে সবচাইতে মারাত্মক কাজ ও কবিরা গুনাহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 'একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার চাইতে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহর নিকট অতিতুচ্ছ ব্যাপার।'

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা, সেখানে এই ধরনের বাণীসম্বলিত কাগজ কৌতূহল তৈরি করে বৈকি।

গণভবনের লেক। ছবি: স্টার

মেঝেতে পড়ে থাকা আরেকটি নথিতে দেখা গেছে দলীয় তহবিলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংসদ সদস্যের দেওয়া অনুদানের তালিকা।

তালিকার প্রথমেই সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের নাম, যিনি ২০১৫ সালের ২১ মার্চ দলীয় তহবিলে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। একই বছর ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি এক লাখ ৪২ হাজার টাকা দেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ।

দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় দেখা যায়, সংরক্ষিত আসনের ২৮ জন সংসদ সদস্য মিলে আওয়ামী লীগের কোষাগারে দুই কোটি ৪৪ লাখ টাকা দিয়েছেন।

নিচতলায় অবস্থিত ইন-হাউস মেডিক্যাল সেন্টারে নানা রকমের ওষুধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

মেঝেতে পড়ে থাকা স্তূপের মধ্যে কোভিড-অ্যান্টিবডি পরীক্ষার দুটি রিপোর্ট দেখা গেছে। সেখানে রোগীর নাম লেখা 'শেখ হাসিনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ আগস্টের অ্যান্টিবডি ফলাফলের রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সম্ভবত দুইবার কোভিড পজিটিভ হয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

গণভবনের ভেতরে পড়ে থাকা ভাঙা গাড়ি। ছবি: স্টার

গণভবনে শেখ হাসিনার কক্ষে পাওয়া আরও নথি প্রমাণ করে রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের কতটা নজরদারির আওতায় রেখেছিলেন তিনি।

শেখ হাসিনার পতনের পর গণভবনে গিয়ে মানুষ জানতে পারে যে, সমাজের প্রভাবশালীদের ফোনে আড়ি পাতা হতো তার নির্দেশে। তার শয়নকক্ষে বিভিন্ন মানুষের কথোপকথনের ট্রান্সক্রিপ্ট পাওয়া গেছে। সশস্ত্র বাহিনীর যেসব সদস্যদের রাজনৈতিক ভাবনা শেখ হাসিনার চেয়ে আলাদা, তাদের একটি তালিকাও পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

তার কক্ষে শতশত পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নিজদলের সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পর্কে নানা রকম তথ্য। ওই তালিকায় গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক এক প্রধানের নামও আছে, বর্তমানে যার বিচার চলছে আইসিটিতে।

৩২তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক প্রার্থীর প্রবেশপত্রও।

গণভবন প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নথি থেকে বোঝা গেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনার নজরদারি কতটা বিস্তৃত ছিল। রাষ্ট্রীয় সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মী, এমনকি বেসরকারি নাগরিকরাও ছিল 'আপা'র নজরদারির আওতায়। এমনকি তার নিজের দলের সহকর্মীরাও এর বাইরে ছিল না।

গণভবনের ভেতরের দৃশ্য। ছবি: স্টার

বেশ কিছু নথিতে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের এলাকাভিত্তিক বর্ণনা এবং তার দলীয় প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক তথ্য দেখা গেছে। তার দলের তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্বলিত অনেক নথিও সেখানে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ১০ জন প্রার্থীর নাম সম্বলিত বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চিঠিও পড়ে ছিল তার বেডরুমে।

মেঝেতে পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, দলীয় কর্মকাণ্ড ছাড়াও শেখ হাসিনা মূলত দুটি বিষয়ে মোহাবিষ্ট ছিলেন—তার বাবা ও বিএনপি।

বাবা বলতে পাগল ছিলেন শেখ হাসিনা। তার কক্ষগুলোতে বাবাকে নিয়ে চলচ্চিত্র, নাটক ও বইয়ের পাণ্ডুলিপির স্তূপ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের কূটনৈতিক তারবার্তা ও টেলিগ্রামের কপিও পাওয়া গেছে।

গণভবনের এখানে-সেখানে বিএনপি সম্পর্কিত অসংখ্য নথিপত্র ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

 

গেট। ছবি: স্টার

মেঝের স্তূপের মধ্যে পাওয়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে বিএনপির ডাকা তিনদিনের অবরোধ কর্মসূচি সম্পর্কে শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয় এবং সরকার কী সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারে তার সুপারিশও ছিল সেখানে।

প্রতিবেদনে বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। তাদের বাড়িঘর ও স্থাপনায় তল্লাশি চালাতে এবং মামলা দিয়ে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করার সুপারিশও করা হয়।

ঢাকা মহানগরীর প্রবেশপথগুলোতে পুলিশ চেকপোস্ট স্থাপন এবং সব ধরনের প্রবেশ ও বের হওয়ার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় সেই প্রতিবেদনে।

ডকুমেন্টে বলা হয়, 'আন্দোলন সফল করতে বিএনপি একটি "লাশ" চায়। তাই তারা তাদেরই একজন কর্মী বা সমর্থককে হত্যার চেষ্টা করতে পারে।'

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে পশ্চিমা কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরকে বিএনপির আন্দোলনে যোগ দিতে রাজি করানোর চেষ্টা করছে।

গণভবনের ভেতরের দৃশ্য। ছবি: স্টার

এতে বলা হয়, বিএনপি 'সহানুভূতি' পাওয়ার জন্য দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন পশ্চিমা দূতাবাসে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করছে।

শেখ হাসিনার সংগ্রহে ২০০৩-২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তার দলের লোকেরা যে নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছিল তার ডকুমেন্টেশনও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার মধ্যে ছিল পৃথক মামলার বিবরণও।

ফরিদপুরের ৩০ বছর বয়সী ট্রাকচালক মেহেদী হাসানের স্ত্রীর পাঠানো একটি চিঠিও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ২০১৩ সালে অবরোধকারীদের দেওয়া আগুনে তার ট্রাক পুড়ে যায়, সঙ্গে মেহেদীর শরীরের ৬৪ শতাংশ। পরে মারা যান মেহেদী। ওই অবরোধ চলাকালে দেওয়া আগুনে দগ্ধদের ছবিও সংগ্রহ করেছিলেন শেখ হাসিনা।

গণভবনে কে কোন রুমে থাকত, সেটা না জানলেও ব্যবহৃত সামগ্রী এবং পড়ে থাকা কাগজপত্র থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকতেন।

একটি ছেঁড়া সোফা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ছবি: স্টার

শেখ হাসিনার বেডরুম লাগোয়া তিনটি কক্ষের দেয়ালেই ছিল ভিন্ন ভিন্ন রং—গোলাপি, নীল ও হলুদ—এবং প্রতিটিতে ছিল হাতে আঁকা পাখি-গাছের চিত্র।

গোলাপি দেয়ালের ঘরটিতে অটিজম সম্পর্কিত নানা ধরনের নথি ছিল, যা পুতুলের আগ্রহের বিষয়। মেয়েদের জন্য লেগো সেটের একটি বাক্স সেখানে পড়ে ছিল। একটি বড় শ্যানেল বাক্সও মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

পাশের নীল দেয়ালের ঘরটিতে হুগো বসের ছেঁড়া নীল শার্টের পাশে মেঝেতে পড়ে ছিল জয়ের বিজনেস কার্ড। ওই কক্ষে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত আইন-কানুন এবং ফাইবার অপটিক সংযোগ সম্প্রসারণ সংক্রান্ত প্রকল্পের নথি ছড়িয়ে আছে। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে শেয়ারবাজারের ২০১০ সালের লেনদেনের বিবরণীও আছে সেখানে। স্টেটমেন্টগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি দূতাবাসের সই ছিল। সত্যায়িত করা স্টেটমেন্টগুলো ছিল জনৈক মোহাম্মদ আমিনুল হকের নামে।

কাকতালীয়ভাবে জয়ের প্রিয় প্রকল্প 'নগদ'র নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, তার নামও মোহাম্মদ আমিনুল হক। গত ৫ ফেব্রুয়ারি আমিনুলের বিরুদ্ধে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে দেওয়া সম্পাদক পরিষদের একটি প্রতিবেদনও সেখানে দেখা গেছে। রুমটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল জয়ের ভিজিটিং কার্ড।

গণভবনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নথি। ছবি: স্টার

পাশের কক্ষে রাদওয়ান মুজিবের বিজনেস কার্ড দেখা গেছে। এই কক্ষে আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সভার কার্যবিবরণীও ছিল। কক্ষের হলুদ দেয়ালে 'গণতন্ত্রের বিজয় ২০২৪' গ্রাফিতি দেখা গেছে, যেটি আঁকা হয়েছে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর। দ্বিতীয় তলায় টিউলিপ সিদ্দিকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন সম্বলিত একটি ফটোকার্ড দেখা গেছে।

শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, জয়, পুতুলসহ পরিবারের সদস্যদের গ্রুপ ছবি বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

গণভবনে রয়েছে এক সুবিশাল বসার ঘর। বসার ঘরের বাইরে মেঝেতে পড়ে আছে শিশুদের খেলনা। একটি ছেঁড়া সোফা পড়ে থাকতে দেখা যায়। বেশকিছু পত্রিকাও সেখানে দেখা যায়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩ আগস্টের পত্রিকা এখানে-সেখানে পড়ে আছে। দ্য ডেইলি সান, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, যুগান্তর, জনকণ্ঠ, বণিক বার্তা, দৈনিক ইত্তেফাক ও নয়া দিগন্ত পত্রিকা দেখা গেছে ড্রয়িং রুমে।

বসার ঘরের বারান্দায় গাছের টব আছে। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো শুকিয়ে গেছে গত ছয় মাসের অযত্নে।

অনেক গাছ শুকিয়ে গেছে গত ছয় মাসের অযত্নে। ছবি: স্টার

এখন বসন্ত। প্রকৃতিও বসন্তকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। গণভবন প্রাঙ্গণের লেকে এক সময় মাছ ধরতেন শেখ হাসিনা, যার অনেক ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। সেই লেকে হয়তো বড় মাছ নেই। লেকের কিছু অংশের পানি হলুদাভাব এবং অন্য অংশে পানি শুকিয়েছে। গণভবন প্রাঙ্গণের রঙ্গন, কাগজফুল ও চন্দ্রপ্রভার মতো ফুলগাছগুলো পানি-যত্ন না পেয়ে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে হয়তো আবার আগের মতো হবে সব।

মূল ফটকের পাশে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছে গজিয়েছে পল্লব। কৃষ্ণচূড়া গাছই জানান দিচ্ছে 'বসন্ত এসে গেছে'।