Image description
 

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড-ওটিপি ফাঁস আতঙ্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর ফলে কাজের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। ইসি সচিবালয় ও মাঠ অফিসে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে পাসওয়ার্ড ইউজার আইডি হ্যাক হয়ে ওটিপি চলে যাচ্ছে তাদের এসএমএস বক্সে। এভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অজান্তেই সংশোধন হয়ে যায় অসংশোধনযোগ্য (ক্রিটিক্যাল) কিছু এনআইডি।

এতে দু’শ্রেণির ব্যক্তি লাভবান হন; এক শ্রেণি আর্থিকভাবে এবং পরের ধাপে পদোন্নতির পথ উন্মুক্ত হয় কিছু কর্মকর্তার। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনটি ওটিপি ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।

তখনই আলোচনায় উঠে আসে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ডাটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ করেন কে, ইসি না অন্য কেউ? এই ঘটনায় দু ধরনের মত পাওয়া যায় বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপে।

ওটিপি জটিলতায় তিনজন কর্মকর্তা ছিলেন বিচারের কাঠগড়ায়। তারা হলেনÑ সিলেটের সাবেক আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (আরইও) ও বর্তমান এনআইডি পরিচালক (অপারেশন) আবদুল হালিম খান, ফরিদপুরের আরইও দুলাল আহমেদ তালুকদার ও কুমিল্লার সাবেক আরইও ও এনআইডির পরিচালক (ডেস্কহীন) ফরহাদ হোসেন।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে বেশকিছু অজানা তথ্য মিলেছে। সার্ভিসে কোনো ত্রুটি কিংবা ডিপার্টমেন্টাল মামলা না থাকলে সিনিয়রিটি অনুযায়ী পদোন্নতির রেওয়াজ আছে। কাজে পারদর্শিতা অনুযায়ী পোস্টিং হয় কর্মকর্তাদের। তবে ইসিতে ঘটছে ব্যতিক্রমী ঘটনা। সিনিয়রের পদোন্নতি আটকাতে ইউজার আইডি হ্যাক ও ওটিপি ফাঁস টক অব দ্য ইসি।

অতীত রেকর্ড বলছে, পদোন্নতির জন্য একজন-অন্যজনকে পেছনে ফেলতে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে হাত করে ইউজার আইডি হ্যাক করে বিপাকে ফেলা হয়েছে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে। যা ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম গোপন রেখে আমার দেশকে জানিয়েছেন।

একইভাবে কেউ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন পেলে পুরনো অভিযোগের নথি সামনে নিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে। সাবেক ও বর্তমান এনআইডির পরিচালক (অপারেশন) ফরহাদ হোসেন ও আবদুল হালিমের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে, গোপন পাসওয়ার্ড ও ওটিপি দিয়েও রোহিঙ্গাসহ প্রবাসে থাকা বাঙালিদের ভোটার করার ঘটনাও ঘটেছে।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদেশে থাকা নাগরিকদের ভোটার করা শুরু করেন। ইসির নজরে এলে চাকরি থেকে বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা রুজু হয়েছে দু’জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এর আগে এমন কাণ্ডে বরাবরই বিতর্কের মুখে পড়ছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অজুহাতে এনআইডিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে ন্যস্ত করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছিল। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বিতর্কিত আইনটি বাতিল হয়েছে।

জানা যায়, দেশের ১২ কোটির বেশি মানুষ ভোটার। তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ইসির ডাটা সেন্টারে সংরক্ষিত আছে। এদের নাম ও জন্ম তারিখ সংশোধন, মৃত ব্যক্তিদের নাম কর্তন কিংবা নতুন ভোটার করার দায়িত্ব ইসি কর্মকর্তাদের। এসব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে ডাটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের কাছে ডিভাইসের মাধ্যমে গোপন পাসওয়ার্ড ল্যাপটপে সন্নিবেশ করা হয়।

গোপন পাসওয়ার্ডটি নিয়ন্ত্রণকারী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়া কেউ জানে না। অথচ অফিসের কাজে কর্মকর্তা যখন বাইরে তার আইডি থেকে এনআইডি সংশোধন হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেক কর্মকর্তা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ধারাবাহিকভাবে হালিম, দুলাল ও ফরহাদের ওটিপি ফাঁস হয়। নির্বাচনের প্রশিক্ষণে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে থাকাবস্থায় ফরহাদ হোসেনের এবং আব্দুল হালিম ও দুলাল আহমেদের ক্ষেত্রেও একই। কীভাবে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে কিছুই জানতে পারেননি বলে আমার দেশকে জানান তারা।

তাৎক্ষণিক অপারেশনাল তদন্তের জন্য তিনজনই সাবেক এনআইডির ডিজিকে অবহিত করেন। ভোটার ডাটা সেন্টারের টেকনিক্যাল কী সমস্যা তা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ জানান। এই সততাই কাল হয় তাদের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের পথচলা শুরু না হলে তদন্ত কার্যক্রম নিষ্পত্তি হওয়া নিয়ে অনন্তকাল ঝুলে থাকতে হতো এমন আশঙ্কা তাদেরও।

বর্তমান এনআইডি ডিজি ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব এ এস এম হুমায়ুন কবীরের দূরদর্শী সিদ্ধান্তে তিরস্কারের বদলে পুরস্কৃত হয়েছেন ওটিপি কাণ্ডের তিনজন। তারা শাস্তির দায় থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওটিপি ফাঁসের মূল কারণ পদোন্নতি আটকানো ও হয়রানির মধ্যে রাখা। ইসি সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের ১ম শ্রেণির কর্মকর্তাদের (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা, ২০১১-এর ৯ বিধি পর্যালোচনা করে আমার দেশ ওটিপি ইস্যুতে তিনটি অলৌকিক ঘটনার আলামত পেয়েছে।

২০০০ সালের ৬ জুন সহকারী সচিব হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন মো. মঈন উদ্দীন খান (পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব), এনআইডি পরিচালক (অপারেশন) মো. আব্দুল হালিম খান ও মো. সাবেদ-উর-রহমান (মৃত)। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতির সিরিয়ালে এগিয়ে আব্দুল হালিম খান। কিন্তু ওটিপি কাণ্ডে বেকায়দায় ছিলেন তিনি।

পরের ব্যাচে দুজন (শেখ আনোয়ার হোসেন ও মো. আব্দুল মোতালেব) অবসরে। তাই পরবর্তী পদোন্নতিতে এগিয়ে এনআইডির পরিচালক (অর্থ) মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান। ওটিপি কাণ্ডে হালিমের পদোন্নতি আটকে থাকলে তিনি হতেন যুগ্মসচিব। পরের জন মো. দুলাল তালুকদার। এই কর্মকর্তাও ওটিপি ফাঁদে চাকরি নিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থায় ছিলেন।

এ কারণে তার বদলে গত সরকারের সময়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন মো. আলাউদ্দীন। সাবেক অর্থ উপদেষ্টার চাপে তাকে পদোন্নতি দিতে বাধ্য হন সাবেক ইসি সচিব ও বর্তমান কারান্তরীণ জাহাঙ্গীর আলম। সিরিয়াল ব্রেক হওয়ায় পিছিয়ে যায় বগুড়ার বাসিন্দা মো. ফরিদুল ইসলাম। একইভাবে, পরের সিরিয়াল মো. ফরহাদ হোসেনের।

তার জুনিয়র এক ব্যাচের চারজন। হালিম ও দুলালের মতো মো. ফরহাদ হোসেনের ইউজার আইডি হ্যাক হলে তিনি ওটিপি কাণ্ডে পড়ে যান। এখনও দপ্তরহীন এনআইডিতে পরিচালক তিনি। এতেই পোয়া বারো পরের ব্যাচের সর্বকনিষ্ঠ মো. সাইফুল ইসলামের। আগের দুজন মো. হুমায়ুন কবির ও খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে।

খুলনার আরইও হুমায়ুনের বিরুদ্ধে ড্রাইভারকে মারধর, নারী অফিসারকে হেনস্তা ও একজন অফিসারের গায়ে হাত তোলার নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত একজন কর্মকর্তা। আর অনিয়মের কারণে খোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান এবং অনিয়ম খতিয়ে দেখছে দুদক।

ওটিপি ফাঁসের কারণ জানতে চাইলে তিনজনই (হালিম, দুলাল ও ফরহাদ) অভিন্ন মত দেন। আমার দেশকে বলেন, ওটিপির বিষয়টি আমরাই ইসির নজরে এনেছিলাম। যাতে আগামীতে কারো ক্ষেত্রে এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। কমিশন বিষয়টি টেকনিক্যাল ব্যক্তিদের দিয়ে যাচাই করে অনিয়মের পথ বন্ধ করতে পারেন। বর্তমান বুয়েট ও ইসির পৃথক কারিগরি টিম এসব অনিয়ম নিয়ে কাজ করছে বলে জানা গেছে।