ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল প্রদেশে এক নারীকে হেনস্তা করে চীনা কৃর্তপক্ষ। ওই ঘটনার রেশ ধরে কয়েক মাস শান্ত থাকা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়েছে দিল্লি ও বেইজিং।
চীন অরুণাচল প্রদেশের ভূখণ্ড দাবি করে এবং ওই অঞ্চলকে দক্ষিণ তিব্বত বা জাংনান বলে অভিহিত করে। আর এ নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। এবার আবার কেন এ উত্তেজনা আর ঠিক কী ঘটেছিল অরুণাচলে?
ব্রিটেনে বসবাসরত প্রেমা ওয়াংজম থংডক তার ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে ব্রিটেন থেকে জাপান সফর করছিলেন। পথে তিন ঘণ্টার ট্রানজিটে চীনের সাংহাই পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ওই নারী। থংডক অভিযোগ করেন, তার জন্মস্থান অরুণাচল প্রদেশে হওয়ায় তাকে আটক করে ১৮ ঘণ্টা ধরে হয়রানি করেছিলেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, তার পাসপোর্টে তার জন্মস্থান ভারতের অরুণাচল প্রদেশ উল্লেখ থাকায় সাংহাই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে ১৮ ঘণ্টা আটকে রেখে হয়রানি করে। বিমানবন্দরে চীনা কর্তৃপক্ষ তার ভারতীয় পাসপোর্টকে ‘অবৈধ’ বলে দাবি করে। সেই সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশকে চীনের অংশ বলেও দাবি করে।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে থংডক ইন্ডিয়া টুডে নিউজ ম্যাগাজিনকে জানিয়েছেন, তিনি ইমিগ্রেশন গেট পেরিয়ে গিয়েছিলেন। এটি ছিল ই-গেট, তাই তিনি তার পাসপোর্টটি ঢুকিয়ে নিরাপত্তা গেটে গিয়েছিলেন। সে সময় এক কর্মকর্তা তাকে ‘ভারত’ বলে সম্বোধন করে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলেন।
সে সময় কেন তাকে বের করে আনা হচ্ছে, জানতে চাইলে কর্মকর্তারা তাকে বলেন, তার ভারতীয় পাসপোর্ট বৈধ নয়। কারণ তিনি অরুণাচল প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। অরুণাচল চীনের অংশ। তাই তার পাসপোর্ট অবৈধ। এর পর তাকে অনেকক্ষণ সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল।
অন্যান্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, থংডক বলেছেন, তাকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসে নতুন টিকিট কিনতে চাপ দেয়। সেই সঙ্গে আরো জানায়, নতুন টিকিট কিনলেই কেবলমাত্র পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হবে।
বিমান কর্তৃপক্ষের এসব ঘটনার কারণে তিনি ফ্লাইট মিস করেন এবং হোটেল রিজার্ভেশনের জন্য বাড়তি অর্থ খরচ হয়েছে। পরে ব্রিটেনের এক বন্ধুর সাহায্যে তিনি সাংহাইয়ের ভারতীয় কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তারাই তাকে একটি ফ্লাইটে করে সাংহাই ত্যাগ করতে সহায়তা করেন।
এর আগে কি একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে? আল জাজিরার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে সেসব তথ্য। ২০০৫ সালে বেইজিং অরুণাচল প্রদেশ থেকে চীনে আসা লোকদের স্ট্যাপলড ভিসা দেওয়ার নীতি চালু করেছিল। অন্য ভারতীয় বাসিন্দারা তাদের পাসপোর্টে স্ট্যাপলড চীনা ভিসা পেয়েছিলেন। তবে চীনের যুক্তি, নিজ প্রদেশের লোকদের নিয়মিত যাতায়াতের জন্য এমন ভিসার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু ভারত কখনো তাদের পাসপোর্টে স্ট্যাপলড চীনা ভিসা গ্রহণ করেনি। তাদের দাবিÑএটি করা মানে অরুণাচল প্রদেশের মানুষ ভারতীয় নন, তা মেনে নেওয়া।
অরুণাচল প্রদেশ বিতর্ক কী নিয়ে? এ বিষয়ে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিগুর সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের একজন অনাবাসিক পণ্ডিত রাজ ভার্মা আলজাজিরাকে বলেছেন, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার।
অরুণাচল নিয়ে দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। এটি ভারতের সবচেয়ে কম জনবহুল রাজ্য। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধক্ষেত্রের একটিতে পরিণত হয়েছিল রাজ্যটি। তখন নামকা চু নদীর দুই তীরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালিয়েছিল চীনা বাহিনী। এর জেরে তাওয়াং ছেড়ে ভারতীয় সেনারা পালিয়েছিলেন। অবশ্য যুদ্ধ জয়ের পর অঞ্চলটি ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল চীনা বাহিনী।
পরে ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে তুলুং লা পাসে আবার সংঘর্ষে জড়ায় ভারত ও চীন। পথটি তিব্বত ও অরুণাচল প্রদেশকে যুক্ত করেছে। সংঘর্ষে নিহত হন চার ভারতীয় সেনা। ২০২০ সালে লাদাখ সংকটের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। লাদাখে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারত ও চীন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। থংডককে হয়রানির অভিযোগের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং মঙ্গলবার জানিয়েছেন, জাংনান চীনের ভূখণ্ড। ভারতের অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করা কথিত অরুণাচল প্রদেশের কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি চীন। থংডকের সঙ্গে চীনের আইন ও নিয়মনীতি মেনে আচরণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এর জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য ও অখণ্ড অংশ। চীন যতই তা অস্বীকার করুক না কেন, এ বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না।