
কিছু ব্যক্তি দৃঢ় নেতৃত্ব, সাহসিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে বিশ্বের গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা শুধু দেশ নয়, মানবজাতির ইতিহাসকেই প্রভাবিত করেছেন। এসব ব্যক্তির অনেকে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা বা স্বাধীনতার লড়াই–সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমন ১০ ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিয়ে আজকের আয়োজন।
মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯–১৯৪৮)

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯–১৯৪৮) ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অগ্রদূত। তিনি ‘সত্যাগ্রহ’ ও অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সরল জীবনযাপন, নিজের হাতে বোনা খদ্দর কাপড় পরিধান এবং সর্বজনীন ন্যায়বিচারের দাবিতে সংগ্রামের কারণে তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয়। গান্ধী কেবল ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে পরিচিত। শুধু অস্ত্র নয়, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যমেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের গুজরাটে গান্ধীর জন্ম। আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা এই ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৪৮ সালে নয়াদিল্লিতে এক হিন্দু উগ্রবাদীর হাতে নিহত হন। তাঁর দর্শনের অন্যতম বার্তা, ‘আপনি বিশ্বে যে পরিবর্তন দেখতে চান, সবার আগে নিজের মধ্যে সেই পরিবর্তন নিয়ে আসুন।’
নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮–২০১৩)

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগ করে ১৯৯০ সালে মুক্তি পান তিনি। পরে ১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ও ১৯৯৪ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন।
ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ক্ষমা ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে তাঁর অবদান আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ২০১৩ সালে মারা গেলেও তাঁর আদর্শ মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য অমর হয়ে আছে। এই মহান রাষ্ট্রনায়ক একবার বলেছিলেন, ‘শিক্ষা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যা ব্যবহার করে আপনি পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারেন।’
জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯)

জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম নায়ক এবং দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট। দেশটির স্বাধীনতাসংগ্রামে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে কৌশলী নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্থপতি’ বলা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হবে পারবেন না, এই নীতি জর্জ ওয়াশিংটন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দূরদর্শিতা ও ন্যায়পরায়ণতা আজও যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধের প্রতীক। ‘সুখ ও নৈতিক কর্তব্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত’ বলে মনে করতেন জর্জ ওয়াশিংটন।
উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫)

উইনস্টন চার্চিল যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে স্মরণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশের মানুষকে নাৎসি হুমকি থেকে রক্ষায় সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর ওই সময়ের অনুপ্রেরণামূলক ভাষণগুলো ব্রিটিশ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, কঠিন সময়েও আশা ও সাহস জুগিয়েছিল।
চার্চিল সাহিত্যিক হিসেবেও প্রশংসিত। ছয় খণ্ডের ‘দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’ বইয়ের জন্য তাঁকে ১৯৫৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
রানি সপ্তম ক্লিওপেট্রা (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৯-৩০)

রানি সপ্তম ক্লিওপেট্রা প্রাচীন মিসরের শেষ ফারাও ও পটোলেমিক সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সক্রিয় শাসক ছিলেন। কৌশলী কূটনীতি, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।
জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ক্লিওপেট্রা তাঁর সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল নিয়ে এখনো আলোচনা হয়। মিসরের স্বাধীনতা রক্ষা ও রোমান সম্রাটদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে তাঁর প্রজ্ঞার প্রতিফলন রয়েছে।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬-৩২৩)
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬-৩২৩) মেসিডোনিয়া সামাজ্যের রাজা ও বিশ্ব ইতিহাসের অসাধারণ প্রতিভাধর সামরিক নেতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা গ্রিস থেকে মিসর এবং বর্তমান ভারতের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
বলা হয়ে থাকে, জীবনে আলেকজান্ডার কখনো কোনো লড়াইয়ে হারেননি। তাঁর বিভিন্ন অঞ্চল জয়ের মধ্য দিয়ে গ্রিক সংস্কৃতি ও আদর্শ বিশ্বের বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাহসিকতা, দূরদর্শিতা ও সুবিশাল অখণ্ড সাম্রাজ্যের স্বপ্ন আলেকজান্ডারকে ইতিহাসে কিংবদন্তির মর্যাদা দিয়েছে। তিনি বলতেন, যে চেষ্টা করবে, তার জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯–১৯৬৮)

মার্টিন লুথার কিং ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও নাগরিক অধিকারের পক্ষের একজন প্রতীক। ১৯৫৫ সালের যাত্রীবাহী বাস বর্জন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করেন। ১৯৬৩ সালে ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণে লুথার কিং মার্কিন জাতির বিবেক কাঁপিয়ে দেন।
লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস অ্যাক্ট পাস হয়, যা বর্ণবৈষম্য বন্ধ করে। ১৯৬৮ সালে তিনি এক শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর পথ অনুসরণ করে আজও যুক্তরাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে চলেছেন একদল মানুষ।
‘বিশ্বের কোনো স্থানে অন্যায়ের ঘটনা ঘটলে তা যেকোনো স্থানের ন্যায়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে’—লুথার কিং জুনিয়রের এ উক্তি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ (১৯২৬-২০২২)

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ রাজপরিবারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর শাসনকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বড় ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও রানি এলিজাবেথের নেতৃত্ব স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে পরিচিতি।
রানি এলিজাবেথ দেশের মানুষ ও কমনওয়েলথের জনগণের কাছে প্রিয় ছিলেন। ‘বেদনা হলো সেই মূল্য, যা আমাদের ভালোবাসার জন্য দিতে হয়’—রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের এ উক্তি অনেকে নানা কারণে স্মরণ করে থাকেন।
জুলিয়াস সিজার (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০-৪৪)
জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমের একজন বিশিষ্ট সামরিক নেতা ও রাজনীতিক। তাঁর গল (বর্তমান ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের কিছু অংশ) বিজয়ের মাধ্যমে রোমের ভূখণ্ড ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিল। তিনি রোমান প্রজাতন্ত্রকে সাম্রাজ্য হিসেবে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানে তিনি তৎকালীন রোমান প্রজাতন্ত্রের একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন।
সিজারের নানা সংস্কার রোম সাম্রাজ্যের ভিত্তি তৈরি করেছিল। জুলিয়াস সিজার গুপ্তহত্যায় নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে রোমান প্রজাতন্ত্রের একধরনের সমাপ্তি হয়েছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। সামরিক দক্ষতা, নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে সিজার আজও স্মরণীয়। ‘আসলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম’—সিজারের এ উক্তি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
সম্রাট অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪-২৩২)
সম্রাট অশোক ছিলেন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহ রক্তপাত দেখে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং অহিংসা, শান্তি ও মানবতার পথে বাকি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
অশোকের শাসনকাল সামাজিক ন্যায়বিচার, প্রাণীর অধিকার ও ধর্মীয় সহনশীলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অশোক তাঁর নীতিবাক্যগুলো পাথর ও স্তম্ভে খোদাই করিয়ে পুরো সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা আজও তাঁর উদার ও জাগ্রত মানসিকতার সাক্ষ্য বহন করে।
তথ্যসূত্র: গ্রিকসফরগ্রিকস ওয়েবসাইট অবলম্বনে