
কলকাতায় শেষ হয়েছে এ সপ্তাহের কম্বাইন্ড কমান্ডার্স’ কনফারেন্স। সেখানে কথা বলার সময় প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বহুমুখী নিরাপত্তা হুমকি ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারত এখন বহুমুখী জটিল নিরাপত্তা পরিবেশের মুখোমুখি। পাকিস্তান তার প্রক্সি যুদ্ধ ও সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের শাসন পরিবর্তন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সেখানে বেড়ে চলেছে ভারতবিরোধী মনোভাব। বেড়েছে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ। সাবেক একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সতর্ক করে বলেছেন, বহুমুখী হুমকি এখন ভারতের জন্য এক বাস্তবতা। এই চ্যালেঞ্জগুলো একসাথে দেখা দিচ্ছে এমন এক সময়ে যখন দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় উদ্বেগজনক ঘাটতি বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, আধুনিক যুদ্ধ ও প্রতিবেশী অঞ্চলের উদীয়মান হুমকি মোকাবিলায় ভারতকে জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
সরকারও একইভাবে ভাবছে বলে ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সহ একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক কর্তৃপক্ষ জানান, যুদ্ধসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশ প্রস্তুত, যদিও ভারত শান্তিতে বিশ্বাসী। বুধবার শেষ হওয়া তিন দিনের কম্বাইন্ড কমান্ডার্স’ কনফারেন্সে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বৈশ্বিক অস্থিরতা, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও উদীয়মান নিরাপত্তা পরিবেশের মধ্যে দেশকে সুরক্ষিত রাখতে সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির আহ্বান জানান। গত মাসে তিনি বলেন, অনিশ্চিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীকে সব ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তা হতে পারে ক্ষুদ্র মেয়াদের সংঘাত থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বহুমুখী হুমকি ভারতের জন্য বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক এক লেফটেন্যান্ট জেনারেল দ্য টেলিগ্রাফ’কে বলেন, পাকিস্তান প্রক্সি যুদ্ধ ও সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাস চালিয়ে স্থায়ী শত্রু হয়ে আছে। চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা অব্যাহত, আর বাংলাদেশের শাসন পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের কাছাকাছি যাওয়া ও ভারতবিরোধী বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মিলে ভারতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ আরও জটিল করেছে। তিনি আরও বলেন, ভারতের তিন বাহিনীরই আধুনিকীকরণ ও নতুন সরঞ্জাম সংগ্রহের তীব্র প্রয়োজন আছে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের ক্রয় বিলম্ব, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির জন্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, জনবলের ঘাটতি, অপর্যাপ্ত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ড্রোন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির অভাব ভারতের সামরিক সক্ষমতায় বড় বাধা। নরেন্দ্র মোদি সরকারের উচ্চাভিলাষী আত্মনির্ভর প্রতিরক্ষা প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও ভারত এখনও আমদানিকৃত সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল। ওই লেফটেন্যান্ট জেনারেল বলেন, ভারতকে ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন বাড়াতে হবে যাতে আত্মনির্ভর ও সজ্জিত হতে পারে। গত জুলাইয়ে অপারেশন সিঁদুর থেকে শিক্ষা তুলে ধরে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর. সিং সতর্ক করেন যে এই সংঘাত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির দেশীয়করণ ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখিয়েছে। তিনি বলেন, এয়ার ডিফেন্সের ভূমিকা পুরো অভিযানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের কিছু দেশীয় ব্যবস্থা ভালো কাজ করেছে। কিছু ততটা ভালো করেনি। এ বার ভাগ্যক্রমে আমাদের জনবসতিগুলো ঝুঁকিতে পড়েনি। কিন্তু পরের বার এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য দ্রুত আরও আকাশ প্রতিরক্ষা, কাউন্টার রকেট আর্টিলারি ও ড্রোন সিস্টেম প্রস্তুত করতে হবে।
এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার উল্লেখ করেন, শেষবার সশস্ত্র বাহিনীর বিস্তৃত পর্যালোচনা হয় ২০১৮ সালে, যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সীমিত বাজেট বরাদ্দের জন্য সংসদের স্থায়ী কমিটি সরকারকে কঠোর সমালোচনা করে। প্যানেলটি বলেছিল, পুরোনো অস্ত্রাগার আধুনিকীকরণে নীতি ও বাজেট- দুটো ক্ষেত্রেই যথাযথ মনোযোগের অভাব রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা রয়েছে। কারণ দেশীয় উৎপাদন প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ইতিমধ্যেই প্রধান প্ল্যাটফর্মে ঘাটতির মুখোমুখি। ভারতীয় বিমানবাহিনী ভয়াবহ যুদ্ধবিমান সংকটে আছে। অনুমোদিত ৪২ স্কোয়াড্রনের বিপরীতে বর্তমানে আছে মাত্র ৩১ স্কোয়াড্রন। একটি স্কোয়াড্রনে ১৮টি বিমান থাকে। বিমানবাহিনীর প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ যুদ্ধবিমান রাশিয়ায় তৈরি। এগুলোর বেশিরভাগই জরুরি আপগ্রেডের প্রয়োজন বা অবসরের পথে। বিদেশি বিমান থাকার অর্থ হলো যন্ত্রাংশের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়।
চীন ও পাকিস্তানের সীমান্তে সামরিকায়ন বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এ বছরের শুরুতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হিন্দুস্তান এয়ারোনটিক্স লিমিটেড প্রথম ব্যাচের তেজস যুদ্ধবিমান সরবরাহে দেরি করায় ভারতীয় বিমানবাহিনী উদ্বেগ প্রকাশ করে। তেজস সংগ্রহে বিলম্বের এই উদ্বেগ দেখা দেয় এমন এক সময়ে যখন চীন তার ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমকে দেয়। এর বিপরীতে ভারতের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এখনো নকশা ও উন্নয়ন পর্যায়ে আছে। নৌবাহিনীও পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান ছাড়াই বিমানবাহী রণতরী পরিচালনা করছে এবং অন্য ঘাটতির সাথেও লড়ছে।
জনবলের ঘাটতিও অব্যাহত আছে। এ বছরের শুরুতে সরকার জানায়, সেনাবাহিনীতে এক লাখেরও বেশি সৈন্যের ঘাটতি রয়েছে। সূত্র মতে, তিন বাহিনীতে মোট প্রায় ১.৪০ লাখ জনবলের অভাব রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্বোধন করা তিন দিনের কনফারেন্সে সশস্ত্র বাহিনীর সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। আর রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ সরবরাহকারী। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফ্রান্স, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি আমদানি করছে ভারত। থিঙ্ক ট্যাঙ্কটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইউক্রেনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক হয় ভারত। যা বৈশ্বিক আমদানির ৮.৩ শতাংশ।
এর আগে ভারত ফ্রান্সের কাছ থেকে বড় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম কিনেছে। যার মধ্যে আছে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান ও ছয়টি স্করপিন শ্রেণির সাবমেরিন। এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য ২৬টি রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী চীন, যার ৬১ শতাংশ রপ্তানি যায় ইসলামাবাদে।