Image description

সিনেমায় দেখা যায়। কিন্তু এবার সিনেমার সেই গল্পকেও হার মানিয়েছেন চট্টগ্রামের আলোচিত আইনজীবী মো. জুলফিকার আলী ভুট্টু। নিজের সাজায় ভুট্টুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে জেল খাটানোর চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে। এমন গুরুতর অপরাধের পরও দীর্ঘদিন সরকারি সহকারী কৌঁসুলির (এপিপি) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ভুট্টু।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের চোরাচালান মামলায় আসামি হয়ে দুবছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন সাবেক এপিপি মো. জুলফিকার আলী ভুট্টু। কিন্তু নিজের সেই সাজা তিনি খাটিয়ে নেন আরেকজনকে দিয়ে। এ ঘটনায় আদালতপাড়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে।

আদালতের নথি বলছে, ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে একটি চোরাচালান মামলায় গ্রেপ্তার হন জুলফিকার আলী ভুট্টু। তিনি প্রথমে সাতদিন কারাগারে ছিলেন। দীর্ঘ বিচার শেষে ১৯৯০ সালের ৯ আগস্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে দুবছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। রায়ের পর থেকেই তিনি পালিয়ে ছিলেন। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পলাতক থাকা অবস্থাতেই ২০০০ সালের ৯ মে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন ভুট্টু।

চট্টগ্রাম বারের সিনিয়র আইনজীবীরা জানান, বারের সদস্য হতে হলে হলফনামা দিতে হয়। সেখানে প্রত্যেক প্রার্থীকে অঙ্গীকার করতে হয় তিনি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত নন এবং কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামিও নন। বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কেউ আইনজীবী হওয়ার সুযোগ পান না। কিন্তু সাজার তথ্য গোপন করে চট্টগ্রাম বারের সদস্য হন ভুট্টু। শুধু তা-ই নয়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দায়িত্বও সামলেছেন দীর্ঘদিন।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী বলেন, ‘যদি কেউ সাজাপ্রাপ্ত হন, তিনি কখনোই বারের সদস্য হতে পারেন না। এই অভিযোগ সত্য হলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। প্রমাণিত হলে সদস্যপদ চলে যাবে।’

কারাদণ্ডের পর থেকে কাগজে-কলমে ভুট্টু পালিয়ে বেড়ালেও ২০০৪ সালে আদালতে হাজির করা হয় মো. এনামুল হককে। তিনি ভুট্টুর দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই। ভুক্তভোগী এনামুল হক বলেন, ‘ভুট্টু আমার খালাতো ভাই। তিনি আমাকে আদালতে নিয়ে যান। আমি বুঝতেই পারিনি তার জায়গায় আমাকে হাজির কা হচ্ছে। পরে আদালত আমাকে জেলে পাঠায়। বিনা দোষে আমি দুই মাস হাজতে ছিলাম। বের হওয়ার পর জানতে পারি আমি আসলে ভুট্টুর সাজা খেটেছি।

এ সময় ভুট্টুর মাধ্যমে নিজের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে দাবি করে এ ঘটনার প্রতিকার চান এনামুল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কারাগারের প্রিজনার রেকর্ডে তখন বন্দির নাম লেখা ছিল ‘মো. জুলফিকার’। কিন্তু শারীরিক বর্ণনায় উল্লেখ করা আছে এনামুলের শরীরের বর্ণনা। সেখানে জুলফিকারের উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি, শ্যামলা বর্ণ, মুখের ডান পাশে ক্ষতচিহ্ন, আঙুলে তিল ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসব বৈশিষ্ট্য জুলফিকার আলী ভুট্টুর সঙ্গে মেলে না। কারণ, তার উচ্চতা কমপক্ষে ছয় ফুট।

এ ঘটনার ভুক্তভোগী এনামুল হকের সঙ্গে কথা বলেছে আমার দেশ। জুলফিকার হয়ে সাজাভোগ করার সময় কারাগারে নথির সঙ্গে তার শারীরিক বর্ণনার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারাগারে নথিতে লেখাÑযিনি জেল খেটেছেন, তার উচ্চতা পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। এনামুল হকেরও পাঁচ ফুট দুই। শ্যামলা বর্ণ, মুখের ডান পাশে ক্ষতচিহ্ন। এনামুল হকেরও মুখের ডান পাশে ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে। শুধু তা-ই নয়, ডান হাতের আঙুলে তিল ছিল বলে কারাগারের নথিতে লেখা আছে। বাস্তবে এনামুল হকের ডান হাতে তিল দেখা গেছে।

চট্টগ্রামের পাঁচজন সিনিয়র আইনজীবী এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আসল ভুট্টু নয়, বরং এনামুল হকই সে সময় সাজা খেটেছেন।

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার নুরীরপাড়ার বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবীর বর্তমানে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেন। তিনিই এ বিষয়ে ১৪ জুলাই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগ দেন। সে সূত্র ধরে আমার দেশ-এর এই প্রতিবেদক অনুসন্ধান চালান।

এরপর ২০ আগস্ট বার কাউন্সিল জুলফিকার ভুট্টুকে নোটিস পাঠায়। বলা হয়, আগামী ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জবাব না দিলে বিষয়টি একতরফাভাবে নিষ্পত্তি করা হবে।

হুমায়ুন কবীর আমার দেশকে বলেন, ‘একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি তথ্য গোপন করে আইনজীবী হয়েছেন। পরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলার দায়িত্বও নিয়েছেন। এটা ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা। সে জন্য আমি বার কাউন্সিলে অভিযোগ দিয়েছি।’

আ.লীগের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি কৌঁসুলি হন ভুট্টু

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের আমলে সহকারী সরকারি কৌঁসুলি হন জুলফিকার আলী ভুট্টু। এরপর ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের এপিপি ছিলেন।

আদালত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে বারের সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হওয়া তো আরো অসম্ভব। তারা মনে করছেন, জনগণের টাকায় বেতনভোগী আইনজীবীর আসনে থেকে প্রতারণা করেছেন ভুট্টু।

তবে ভুট্টুর এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে ছিলেন আওয়ামী লীগের বড় নেতারা। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তা অস্বীকার করেন আইনজীবী জুলফিকার আলী ভুট্টু। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা, কারাগারের নথিÑসবকিছুর প্রমাণপত্র রয়েছে জানানে ভুট্টু বলেন, ‘আগে বলুন আপনি এই তথ্য কোথা থেকে পেয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই।’ পরে এনামুলের দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে ভুট্টু বলেন, ‘এনামুল হককে আমার সামনে নিয়ে আসুন।’