Image description

যতই দিন যাচ্ছে ততই বেড়িয়ে আসছে আওয়ামী লীগের আমলে ব্যাংক খাতের লুটপাটের ক্ষত-বিক্ষত চিত্র। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দেড় দশকেরও বেশি শাসনামলে নির্লিপ্তভাবে লুটেপুটে খাওয়া হয়েছে এ খাতটিকে। যার ফলে ভেঙে পড়ে দেশের অর্থনীতির কোমড়। হুহু করে বাড়তে থাকে দেশের মুদ্রাস্ফীতি। একদিকে কাঙ্খিত পরিমাণে আয় বাড়েনি, অন্যদিকে মুদ্রার মান কমেছে, ফলে জীবন-যাপন আর স্বাভাবিক থাকেনি, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ ও অতি দরিদ্র পরিবারগুলো সংসার চালাতে গিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছে।

শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্টরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নিয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লুটপাটে অন্তত ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে, আর ১৫টি ব্যাংক টিকে থাকার জন্য লড়াই চালাচ্ছে। এদিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের অংক বেড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চে নন-পারফর্মিং ঋণের (এনপিএল) হার ছিল ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এক বছর আগে গত বছরের জুনে এ হার ছিল মাত্র ১২ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বছরের জুনের শেষে মোট ঋণ ও অগ্রিম দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন, খেলাপি, রাইট-অফ, পুনঃতফসিলকৃত ও ঋণ আদালতে আটকে থাকা ঋণসহ এর পরিমাণ শিগগির ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে নজরদারি ও নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আগে যেসব ঋণ পরিশোধ না হওয়া সত্ত্বেও কাগজে ‘নিয়মিত’ হিসেবে দেখানো হতো, সেগুলো এখন মন্দ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রভাব ও সুবিধার মাধ্যমে বিতরণ করা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগুলো একে একে প্রকাশ পাচ্ছে, আর মন্দ ঋণের পরিমাণও বাড়ছে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, নিয়মনীতি সঠিক পরিপালনের কারণে এখন তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। ফলে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং খাতে খুব দূরাবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর জন্য সুদের হার কমানো যাচ্ছে না, পলিসি রেট কমানো যাচ্ছে না। এসবের কারণে চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ এখন দুষ্টু চক্রের মত হয়ে গেছে। এই বিশ্লেষক আরও বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে এখন অনেকটাই স্বচ্ছতার চর্চা হচ্ছে যার ফলে আগে যেসব ঋণ লুকানো হয়েছে সেগুলো এখন বেড়িয়ে আসছে।

তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাত এস আলম গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছেন। এর মধ্যে পাচার করেছেন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। গ্রুপের এখন খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ২০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের ঋণ ১৩ হাজার কোটি টাকা, খেলাপি ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

অপর একটি গ্রুপের মোট ঋণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা এর মধ্যে খেলাপি ৭ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। নাসা গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ৯ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। রপ্তানি বিলের অর্থ দেশে এনে গ্রুপের কিছু ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে। ওরিয়ন গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি দেড় হাজার কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপের অপরিশোধিত ঋণ ৯ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। খেলাপি ৭ হাজার কোটি টাকা। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মোট ঋণ ১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। বেনামে নিয়েছেন আরও ২ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ৬৪০ কোটি টাকা। এছাড়া চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ নিয়েছে সেগুলো এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংক দখল করে লুটপাট শুরু হয়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে লুটপাট চরমে ওঠে। এ কারণে ওই সময়ে খেলাপি ঋণও মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা অনুযায়ী, ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিনশতাধিক প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপির সাথে জড়িত।

শীর্ষনিউজ