ড. মো. মোজাম্মেল খান নামের দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কমিশনার ছিলেন। হাসিনার অলিগার্ক এই ব্যক্তি প্রায়ই হুঙ্কার দিয়ে বলতেন, ‘চুনোপুঁটি নয়, দুদকে রাঘববোয়ালও ধরা পড়ছে।’ দুদকে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করা ওই কমিশনারের সময় বিরোধী দলের লোকজনকে হয়রানি করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের লাঘববোয়ালদের কাউকে স্পর্শ করা হয়নি। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থা হয়েছে সেই দুদকের মতোই। দীর্ঘ ১৫ বছর জুলুম-নির্যাতন এবং হামলা-মামলা-কারাভোগ করা কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে।
জামায়াতে ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলো ‘বিএনপির চাঁদাবাজি’র খবর ফলাও করে প্রচার করছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করে অভিযুক্ত কিছু নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয়েছে। কিন্তু সেটি দুদকের ‘চুনোপুঁটি-রাঘববোয়াল ধরার গল্পের মতোই। চাঁদাবাজি এবং হাসিনার অলিগার্ক লুটেরাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং তাদের কাছে দেনদেন অভিযোগে দলের কিছু চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও রাঘববোয়ালরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাসিনা পালানোর পর পরিবহন সেক্টর কোনো কেন্দ্রীয় নেতার লোকজন দখল করে চাঁদাবাজি বাণিজ্য করছে সেটি সবাই জানেন। আবার দীর্ঘ আট বছর পর ভারত থেকে ফিরে এসে কোন নেতা লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের মালিকানাধীন গাড়িতে চড়ে নিজ এলাকায় গিয়ে সংবর্ধনা নিয়েছে এবং সে গাড়ি বহরের দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে তা ওপেন সিক্রেট। কেন্দ্রের ওই প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দুদকের মতো দলের চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় দলটির চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগের সুফল আসছে না। ফলে চাঁদাবাজি কার্যক্রম চলছেই আর নির্বাচনের আগেই বিতর্কিত হয়ে পড়ছে বিএনপি।
এর আগে হাসিনা পালানোর পর চট্টগ্রামের শীর্ষ বিএনপি নেতাদের তদারকিতে হাসিনার অলিগার্ক বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি একটি ওয়্যারহাউজ থেকে একে একে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নেয়ার ঘটনায় জড়িত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল দলটি। নোটিশ পাওয়া বিএনপি নেতারা হলেনÑ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং কর্ণফুলী থানা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া। পরে তাদের দলে ফিরিয়ে নিলেও ভারত ফেরত স্থায়ী কমিটির সদস্য এস আলমের কাছে সুবিধা নিলেও ওই নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ওই নেতা এখন বিএনপির অন্যতম নীতি-নির্ধারক হয়ে উঠেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএনপি যদি চাঁদাবাজি এবং হাসিনার অলিগার্কদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেয়া কেন্দ্রীয় নেতা এবং স্থানীয় কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করত তাহলে সে বার্তা তৃর্ণমূল পর্যায়ে যেত। এতে চুনোপুঁটি নেতারা সতর্ক হতেন। রাঘববোয়াল তথা স্থানীয় কমিটির চাঁদাবাজ ও অসাধু সুবিধা গ্রহণ করা নেতাদের কেন্দ্র রেহাই দেয়নি; অতএব তৃণমূল নেতারা সতর্ক হতেন। কয়েক দিন আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রের দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজ রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দল থেকে বের করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, দু’একজন বিতর্কিত রাঘববোয়ালকে বের করে দিলে দলের ক্ষতি হবে না। কিন্তু সেটি দেখা যায়নি। ফলে বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াত নেতারা বলছেন, ‘এক চাঁদাবাজকে ক্ষমতাচ্যুত করেছি, আরেক চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আনার জন্য নয়।’
বিএনপি চাঁদাবাজি ও হাসিনার অলিগার্ক লুটেরাদের কাছ থেকে অসৎ সুবিধা নেয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মাঠপর্যায়ের নেতারা চাঁদাবাজি ও নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা নিহত হয়েছেন। উপজেলার বাংগড্ডা বাজারে দলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে হেসাখাল ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. সেলিম ভূঁইয়া নিহত হন। স্থানীয় সূত্র জানায়, বিএনপির উপজেলা সভাপতি মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। একই সময় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়ার সমর্থকরা একটি গাড়িবহর নিয়ে বাংগড্ডা বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে এবং সেলিম ভূঁইয়া নিহত হন।
এর আগের দিন পাবনায় চাঁদা দিতে না চাওয়ায় বাস পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠে যুবদল নেতার বিরুদ্ধে। ৩১ জানুয়ারি রাতে মালিগাছা ইউনিয়নের শংকরপুর এলাকায় তামিম ট্রাভেলস নামের যাত্রীবাহী ওই বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। ১ জানুয়ারি ভুক্তভোগী বাসচালক এনামুল হক পাবনা সদর থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। মালিগাছা ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রানু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ২০ হাজার টাকা চাঁদা না দেয়ায় বাস পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম অভিযোগ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।