বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শিক্ষার্থীরা সবসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল, নেতৃত্বের পরিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন দেশের ইতিহাস গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেতে চেয়েছে—কেউ সফল হয়েছে, কেউ ব্যর্থ।
বিএনপি একসময় ছাত্র সমাজের সাথে সফলভাবে সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই দলটি বুঝতে পেরেছিল যে শিক্ষার্থীরা শুধু রাজপথে আন্দোলন নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব গঠনে, জনমত তৈরি করতে এবং নির্বাচনী ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিতে আসেন, তিনি ছাত্রদের সাথে ভিন্নভাবে সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রতিপক্ষ মনে করেননি, বরং তাদের কথা শোনার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে, যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, তখন সেখানে শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদ ছিল। কিন্তু তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যাননি বা দমন-পীড়নের পথে যাননি। বরং তিনি তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলোচনার চেষ্টা করেন। তার এই সাহসী পদক্ষেপ প্রথমে প্রতিরোধের মুখে পড়লেও, পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করে। এটি দেখিয়ে দেয় যে তিনি তরুণদের কণ্ঠ রোধ করতে চাননি, বরং তাদের সাথে সংলাপ করতে চেয়েছিলেন।
অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিএনপি শুরু থেকেই ছাত্রদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল। শুধুমাত্র রাজনীতির জন্য নয়, বরং শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজকর্মীদেরও সম্পৃক্ত করেছিল। জিয়া ছাত্রদলকে শুধু রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির একটি ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক উৎসব, মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, সরকারি বিদেশ সফরে মেধাবীদের অন্তর্ভুক্তি—এসব উদ্যোগ বিএনপিকে শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং শিক্ষার্থীদের ব্যাপক পরিসরে আকৃষ্ট করেছিল। তার সরকার ছাত্রদের জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত করেছিল, যেমন ‘খাল খনন কর্মসূচি’, যেখানে যুবকদের ব্যবহারিক উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। এসব উদ্যোগ ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে বিএনপিকে তরুণদের কাছে আধুনিক, গতিশীল ও যুববান্ধব দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। জিয়াউর রহমানের নিজস্ব ব্যক্তিত্বও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—তার হাফ হাতা সেন্টু গেঞ্জি, খাকি প্যান্ট, হেড ক্যাপ, সানগ্লাস পরা ও মাঠপর্যায়ে সরাসরি কাজ করার ধরন তাকে সে সময়ের তরুণদের কাছে এক জনপ্রিয় আইকন করে তুলেছিল। তিনি নীতির মাধ্যমেও এবং ব্যক্তিগত ক্যারিশমার মাধ্যমেও তরুণদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই ধারা অব্যাহত রাখেন এবং শিক্ষার্থী ও তরুণদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। তার শাসনামলে ছাত্রদের কল্যাণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করা হয়, যার মধ্যে জিয়াউর রহমান আমল থেকে চালু হওয়া ‘আমরা নতুন, আমরা কুঁড়ি’ অন্যতম, যা তরুণ প্রতিভাবানদের তুলে ধরার জন্য ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। বিএনপির নীতিমালা কেবল সাধারণ শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য সীমিত ছিল না, বরং নারী শিক্ষার্থী, মাদ্রাসার ছাত্র, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীদের জন্যও বিস্তৃত ছিল। বিএনপির তৎকালীন কার্যক্রম বিভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে আসা তরুণদের কাছে দলটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
কিন্তু আজ বিএনপি ছাত্র আন্দোলনের সাথে ক্রমশ দূরত্ব তৈরি করছে। অতীতে দলটি ছাত্রদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিত, সমর্থন করত বা সমালোচনাকে মোকাবিলা করত, আজ তা অনুপস্থিত। বিশেষ করে ডিজিটাল আন্দোলন ও বিকেন্দ্রীভূত যুব রাজনৈতিক সচেতনতার এই যুগে, বিএনপি শিক্ষার্থীদের সাথে সংযোগ রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। দলটি যেন এক সঙ্কটে পড়ে গেছে—বিএনপি কি সত্যিই ছাত্র আন্দোলনকে ভয় পাচ্ছে, নাকি তারা কেবল আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে? এই লেখায় সেই অনুসন্ধান করবে, কেন বিএনপির ছাত্র সমাজের সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়েছে, সমস্যাটি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসেছে, নাকি বিএনপির কৌশলগত ভুলের কারণে হয়েছে? অথবা কোনো বাহ্যিক কারণ এর পেছনে কাজ করছে? সেইসাথে বিএনপির অতীত সাফল্য থেকে কী শেখা যায়, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের তরুণ প্রজন্মের সাথে নতুন করে সংযোগ স্থাপন করা যায়।
বিএনপি কি এখনো মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত?
বিএনপি আজ শিক্ষার্থী নেতৃত্বের সাথে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হতে পারছে না, এটা ভয় বা বিরোধিতার কারণে নয়, বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের ফলে সৃষ্ট মানসিক আঘাতের কারণে। ২০০৬ সাল থেকে দলটি টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত, গণগ্রেপ্তার, নেতৃত্বের কারাবাস ও নির্বাসন, সংগঠনের ভাঙন—এসব পরিস্থিতি বিএনপিকে প্রতিরক্ষামূলক রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। ১/১১ সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিএনপির জন্য এক নতুন বাস্তবতার সূচনা করে, নতুন প্রজন্মের সাথে সংযোগ তৈরির বদলে দলের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে কেবল ঐক্য রক্ষা করা এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এই দীর্ঘ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি করেছে, যার ফলে বিএনপি শিক্ষার্থীদের নতুন আন্দোলনগুলোকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত, কারণ তারা আশঙ্কা করে যে, বাইরের শক্তিগুলো আবারও দলকে কোণঠাসা বা সরিয়ে দিতে পারে।
অনেক সমালোচক ১/১১-এর জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন, কারণ তখন তারা ক্ষমতায় ছিল। তবে এই যুক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে যে, বিএনপি তখন চার-দলীয় জোট সরকারের অংশ ছিল, যার ফলে দায়ভার সবারই হওয়া উচিত ছিল। একই যুক্তিতে, আজ যদি ছোট দলগুলোর নেতা যেমন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের শাসনের সমর্থনের জন্য অভিযুক্ত হন, তাহলে তাদের পূর্ববর্তী সরকারে থাকার জন্যও সমানভাবে দায়ী করা উচিত। এই বেছে বেছে দায় দেওয়ার প্রবণতা বিএনপির মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে যে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
জুলাই ২০২৪-এর বিপ্লবের পর, অনেকেই আশা করেছিল যে বিএনপি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। তবে যখন নতুন ছাত্র-নেতৃত্ব একটি দল গঠনের পরিকল্পনা করে, অধ্যাপক ইউনুস তাদের সমর্থন দেন, নাগরিক সমাজের জরিপে ছাত্রদের সম্ভাব্য দেখানো হয় এবং সেনাপ্রধান শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মন্তব্য করেন—এসব ঘটনায় বিএনপির মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। দলটির অনেক নেতা মনে করছেন, এটি হয়তো ‘মাইনাস টু ফর্মুলার’ আরেকটি রূপ, যার লক্ষ্য বিএনপিকে রাজনীতি থেকে একেবারে সরিয়ে দেওয়া।
সমস্যাটি হচ্ছে, ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বিএনপির এই মানসিক অবস্থাকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিএনপির এই মানসিক আঘাত কোনো রাজনৈতিক অজুহাত নয়—এটি একটি গভীরভাবে গেঁথে থাকা অভিজ্ঞতা, যা শিক্ষার্থী ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো প্রায়শই বুঝতে চাচ্ছে না। বর্তমানে যে ছাত্রনেতারা আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তারা ২০০৬ সালের ঘটনাবলি খুব কমই স্মরণ করতে পারেন বা সেই সময়ের বাস্তবতাকে অনুভব করতে পারেন না। ফলে, তারা বিএনপির দ্বিধাকে জেদ বা দূরদর্শিতার অভাব বলে ধরে নিচ্ছেন, অথচ তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, বিএনপি ১৭ বছরের দমন-পীড়নের কারণে এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে।
একই সময়ে, বিএনপি নিজেও এই মানসিক স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য কোনো সুসংগঠিত পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ভয় কিছুটা যৌক্তিক হলেও, দলটি সক্রিয়ভাবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা না করায় শিক্ষার্থীদের, যুবসমাজের, এমনকি নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের সাথেও দূরত্ব তৈরি করছে। নেতারা দলের ভেতরে হতাশা দূর করতে বা কর্মীদের মানসিক চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এই নিষ্ক্রিয়তাই বিএনপির বড় দুর্বলতা হয়ে উঠেছে— দলটি শুধু শিক্ষার্থী ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছে যে তারা পরিবর্তনের পথে বাধা নয়, বরং নিজেদের কর্মীদেরও আশ্বস্ত করতে পারছে না যে বিএনপি এখনো সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
এই ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও দেখা গেছে। পাকিস্তানের পিএমএল-এন ও পিপিপি, জিম্বাবুয়ের মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ (এমডিসি) এবং মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড দীর্ঘ রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পর যখন তরুণ প্রজন্মের সাথে পুনঃসংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছে, তখন তারা অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়ে নিজেদের অবস্থান দুর্বল করেছে। বিএনপি যদি একই ভুল করে, তাহলে তারা শুধু বর্তমান প্রজন্মকে হারাবে না, বরং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্বেও তাদের অবস্থান দুর্বল হবে। অন্যদিকে, যদি শিক্ষার্থী ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিএনপির এই মানসিক অবস্থাকে না বোঝে এবং দলটিকে আরও একঘরে করে রাখে, তাহলে প্রকৃত বিরোধী জোট গড়ে তোলার বদলে, তারা নিজেরাই বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সুবিধা করে দেবে।
বিএনপি কি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রনেতাদের আচরণে বিস্মিত?
বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বহু বছর ধরে একসঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই করেছে, কঠোর দমন-পীড়ন সহ্য করেছে – গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দীর্ঘদিনের এই জোট, যা সংকটের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল, হয়তো বিএনপির মনে একটি ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে জামায়াত শুধু রাজনৈতিক মিত্র নয়, বরং ভাইয়ের মতো। কিন্তু জুলাই ২০২৪-এর পরবর্তী বাস্তবতা সেই ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। যখন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রনেতারা বিএনপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগ তুলে প্রচার চালাতে শুরু করল, এমনকি আওয়ামী লীগের প্রচারণার সঙ্গেও মিল রেখে কাজ করল, তখন বিএনপি সম্ভবত এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই পরিবর্তন বিএনপিকে মানসিকভাবে হতভম্ব করে দিয়েছে, কারণ তারা কল্পনাই করতে পারেনি যে এতদিনের মিত্ররা ঠিক এই সময়ে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।
একইভাবে, বিএনপি হয়তো ধরে নিয়েছিল যে ছাত্ররা—যারা বিএনপির সংগ্রামের সময় জন্ম নিয়েছে ও বড় হয়েছে—অবশ্যই তাদের দিকেই ঝুঁকবে। কিন্তু বাস্তবে ছাত্রনেতারা নিজেদের স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছে, তারা পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, কোনো পুরনো রাজনৈতিক দলের অংশ হতে চায়নি। বিএনপি এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা তাদের হতভম্ব হওয়ার একটি প্রধান কারণ।
এটি একটি মৌলিক রাজনৈতিক সত্য না বোঝার ফলে হয়েছে; রাজনীতি ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব বা চিরস্থায়ী সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে না, বরং স্বার্থের ওপর চলে। মেকিয়াভেলি থেকে শুরু করে আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি নৈতিকতার ওপর নয়, বরং কৌশলের ওপর ভিত্তি করে চলে—যেখানে প্রতিটি পক্ষ নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। জামায়াতে ইসলামী সেটাই করছে, যেমন তারা অতীতেও করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতের পক্ষে থাকা, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও এরশাদের সঙ্গে জোট গঠন করা, ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মেলানো এবং ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া—সব ক্ষেত্রেই জামায়াত তাদের নিজস্ব স্বার্থে কাজ করেছে। এমনকি ২০০৯ সালে বিএনপিকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল, কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক টিকে থাকা, বিরোধী দলের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করা নয়।
বর্তমান পরিস্থিতি একই ধারায় চলছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পর, নিজেদের নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। তারা বিএনপির দুর্বলতা থেকে দূরে সরে গিয়ে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চায়। তাদের ছাত্র সংগঠন, ইসলামী ছাত্রশিবির, যা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেছিল, দীর্ঘদিন গোপনে সক্রিয় ছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে এসে বিপ্লবের কৃতিত্ব দাবি করছে। কিন্তু এটি ছিল একটি বড় ধরনের কৌশলগত ভুল—গোপনে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে, তারা আগেভাগেই নিজেদের পরিকল্পনা ফাঁস করে ফেলেছে। এর ফলে তাদের প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW, সহজেই তাদের মোকাবিলার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এখন তারা অপ্রয়োজনীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে নিজেরাই নিজেদের দুর্বল করেছে, যা ভবিষ্যতে তাদের জন্য আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে, যার খেসারত ভবিষ্যতে তাদের দিতে হতে পারে।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো জামায়াতে ইসলামী ইসলামিক স্কলার মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীকে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত করার চেষ্টা। অতীতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো ইসলামী চিন্তাবিদরা সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সম্মান পেতেন, কারণ তিনি ন্যায়ের পক্ষে থাকতেন। সাঈদীর গ্রহণযোগ্যতা এতটাই ছিল যে, এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও তার ফাঁসির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু আজহারীর রাজনৈতিক অবস্থান তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার সাম্প্রতিক মন্তব্য, ‘এক দল খাচ্ছে, আরেক দল প্রস্তুতি নিচ্ছে’—অনেকেই মনে করছে যে এটি বিএনপির বিরুদ্ধে ইঙ্গিতপূর্ণ। ফলে যারা আগে তাকে নিরপেক্ষ মনে করতেন, তারাও এখন সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। তাছাড়া, অতীতে তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মাহফিলে অংশ নিয়েছিলেন, তখন কেন তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি?—এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে। সাঈদী সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন, কিন্তু আজহারী এই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি, বরং তিনি এক বিশেষ রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। এটিও জামায়াতে ইসলামীর আরেক ধরনের ইচ্ছাকৃত ভুল। কাজেই সে তার দ্রুত রাজনৈতিক খেলার কার্ড শেষ করে ফেলছে।
বিএনপির জন্য এই পরিস্থিতি থেকে নেওয়ার শিক্ষা কী? প্রথমত, রাজনীতিতে আবেগের কোনো জায়গা নেই। জামায়াত বিএনপিকে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, ছাত্ররাও বিএনপির বিরোধিতা করছে না—তারা কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছে, যা রাজনীতির সাধারণ নিয়ম। বিএনপি এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়া উচিত নয়, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিএনপির উচিত হতভম্ব না হয়ে এই সংকটকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখা। যদি জামায়াত, ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই প্রচার অভিযান চালাত, তাহলে বিএনপির আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকত না। কিন্তু এখন যেহেতু এটি ঘটছে, বিএনপির জন্য এটি একটি সময় সুযোগ—যাতে তারা নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে, সংগঠনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং নতুনভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো—সমস্যার মধ্যেই সমাধানের চাবিকাঠি থাকে। বিএনপি হয়তো এখনো হতভম্ব অবস্থায় আছে, কিন্তু তারা যদি এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তাহলে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।
বিএনপি কি ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিভ্রান্ত?
গত সতেরো বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে, যা দেশের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, ছাত্রনেতা ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করেন, ভারত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে, বিরোধী দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালাতে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে, বিএনপি ভারতের বিষয়ে কী অবস্থান নিতে চায়, তা স্পষ্ট করতে না পারায় নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপি ভারতের নতুন মিত্র হতে চাইছে। দলটি এই বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতি প্রকাশ না করায় সমালোচক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এবং প্রতিপক্ষরা প্রচার করছে যে, বিএনপি গোপনে ভারতের সাথে জোট বাঁধছে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যও এই বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়েছে। দলের একাংশ প্রকাশ্যে ভারতের সমালোচনা করলেও, অন্য কয়েক নেতা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রাখার পক্ষে কৌশলগত বক্তব্য দিচ্ছেন। ফলে, ছাত্রনেতা ও তরুণ কর্মীরা মনে করছেন, বিএনপি ভারতের ব্যাপারে আপস করতে চাইছে, যা তাদের কাছে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হচ্ছে। তরুণদের অনেকেই ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপির দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে দলের অন্যতম পরিচয় বলে দেখে। কিন্তু যখন বিএনপির কিছু নেতা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দেন, তখন তরুণরা ভাবতে শুরু করে, বিএনপিও কি আওয়ামী লীগের মতো ভারতকে খুশি করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে? এই সন্দেহ দলের গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
একই সঙ্গে, কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপির দ্বিধা কিছুটা যৌক্তিকও। ভারত শুধু একটি আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং এটি এখন বৈশ্বিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করছে। বিএনপি অতীতেও ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বেশ কিছু ক্ষতি শিকার হয়েছে, বিশেষ করে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার পর থেকে দলটির ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই, দলটি হয়তো আরও কূটনৈতিক চাপ এড়াতে সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে। তবে ইতিহাস বলে, শুধুমাত্র কূটনৈতিক ভারসাম্য ধরে রাখা যথেষ্ট নয়—জনগণের আবেগ ও মতামতের সাথে সংগতি রেখে সুস্পষ্ট ন্যারেটিভ তৈরি করাটাই রাজনৈতিক বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন, শাসকদের অবশ্যই জনগণের ইচ্ছাকে বুঝতে ও তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। বিএনপি যদি বাংলাদেশের জনগণের ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাবকে উপেক্ষা করে, তাহলে তারা তরুণদের মন জয় করতে ব্যর্থ হবে।
এই সমস্যাটি শুধু বিএনপির একার নয়। বিশ্বব্যাপী বিরোধী দলগুলো ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে নিজেদের অবস্থান নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। আফগানিস্তানে তালেবান, যারা একসময় ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল, এখন ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছে। সিরীয় বিদ্রোহীরা, যারা একসময় পশ্চিমা হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধী ছিল, এখন তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। এ ধরনের বাস্তবতা দেখায় যে, ক্ষমতায় যাওয়ার পথে আদর্শগত বিরোধ কৌশলগত সম্পর্কের দিকে মোড় নিতে পারে। একইভাবে, যদি জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রনেতারা একদিন ক্ষমতায় আসে, তবে তাদেরও ভারতের সাথে সম্পর্ক গড়তে হবে। তবে বিএনপির অবস্থান ভিন্ন, কারণ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এবং অতীত অভিজ্ঞতার কারণে জনসাধারণের কড়া পর্যবেক্ষণের মধ্যে রয়েছে। বিএনপি যদি দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থানে থাকে, তাহলে তা আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।
এই অনিশ্চয়তা দলের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যেও হতাশা সৃষ্টি করছে। তারা মনে করছেন, দলটি ভারতের বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না। তরুণ প্রজন্ম, যারা ইতিমধ্যেই বিএনপির প্রতি সংশয়ে রয়েছে, তারা এখন প্রশ্ন তুলছে, বিএনপি কি সত্যিই জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে? বিএনপি এই বিষয়ে চুপচাপ থাকতে পারে না। যদি তারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অন্যরা বিএনপির জায়গায় নিজেদের মতামত বসিয়ে দেবে, আর জনগণের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হবে যে বিএনপি ভারতের কাছে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে। যদি দলটি দ্রুত ও পরিষ্কার বার্তা না দেয়, তাহলে তরুণদের আস্থা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং বিএনপি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন হারাতে থাকবে।
বিএনপি কি তরুণ নেতাদের সামনে আনতে দ্বিধাগ্রস্ত?
বিএনপির তরুণ ও নতুন নেতৃত্বকে সামনে না আনার প্রবণতা দলটির জন্য একটি বড় দুর্বলতায় পরিণত হচ্ছে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায়। দীর্ঘদিনের সংগ্রামী ও অভিজ্ঞ নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পরিবর্তনশীল, তরুণপ্রধান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নবীন নেতৃত্বের চাহিদা উপেক্ষা করা দলটির জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিএনপির নেতৃত্ব একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যে আটকে আছে—একদিকে দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের সম্মান জানানো, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে তরুণ, উদ্যমী ও ক্যারিশমাটিক নেতাদের সামনে আনা।
বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রজন্মগত পরিবর্তন ঘটানো, কিন্তু একই সঙ্গে দল ভাঙনের ঝুঁকি এড়ানো। মনে হচ্ছে, দলটি নতুন তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনতে ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে, অবহেলিত প্রবীণ নেতারা জামায়াতে ইসলামী বা নাগরিক কমিটির সাথে যোগ দিতে পারেন। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কিছু নেতা ও কর্মী, যারা চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কাজে যুক্ত ছিলেন, তারা ইতোমধ্যে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছেন। আবার কিছু হতাশ নেতা, যারা বিএনপির ধীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ক্লান্ত, তারা ছাত্রনেতাদের নতুন আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছেন। এই দ্বিধা বিএনপিকে স্থবির করে দিচ্ছে—যেখানে দলটি নিজেই সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে।
শুধু অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বিএনপি রাজনীতির দৃশ্যমান বাস্তবতাকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। নাগরিক কমিটি যেখানে তরুণদের আকর্ষণ করছে, সেখানে বিএনপির ছাত্রনেতাদের প্রতি দূরত্ব বজায় রাখা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। বিএনপি যদি প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের সাথে কাজ না করে, তাহলে তারা ধীরে ধীরে বিএনপিকে একটি পুরনো, গতানুগতিক রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখবে, যা পরিবর্তনের পক্ষে নয়। বর্তমান প্রজন্ম গোপন রাজনৈতিক কৌশল বুঝতে পারে না, বরং তারা স্বচ্ছতা, স্বীকৃতি এবং সরাসরি সম্পৃক্ততা চায়। বিএনপির উচিত শিক্ষার্থীদের এক বড় ভাই বা পথপ্রদর্শকের মতো ভূমিকা পালন করা, যারা শুধু সমর্থন করবে না, বরং তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিএনপির উচিত শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি, সভা ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো, যাতে জনগণ বুঝতে পারে বিএনপি তরুণদের সাথে সম্পৃক্ত এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য কাজ করছে।
বিএনপি সম্ভবত বুঝতে পারছে না, নারীদের মধ্যে দলটির বিশাল জনপ্রিয়তা রয়েছে, যা বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘদিনের জনপ্রিয়তার ফল। তিনি এখনো বাংলাদেশের নারীদের জন্য শক্তি ও নেতৃত্বের প্রতীক। তবে, বিএনপির ভাবা উচিত—যদি খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকেন, তাহলে তার উত্তরাধিকার কে বহন করবে? বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন, যাদের স্ত্রী বা কন্যারা এই ভূমিকা নিতে পারেন—যদি তারা বুদ্ধিমান, রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংযুক্ত থাকেন। কিন্তু দলটি কেন তাদের সামনে আনতে চায় না? তারা কি কোনো কৌশলগত মুহূর্তের অপেক্ষায়? যদি তা হয়, তাহলে সেই সময় এখনই। একটি সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সন্তানদের সম্পৃক্ত করা—যারা শিক্ষিত, রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং দলে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। যদি প্রবীণ নেতারা সরাসরি পেছনে না সরে যেতে চান, তাহলে অন্তত তারা তাদের দক্ষ সন্তানদের সামনে নিয়ে আসতে পারেন।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ কাউন্সিল না করাটাও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলটি মনে করছে, এখন কাউন্সিল করলে কিছু নেতা প্রতিদ্বন্দ্বী দলে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু দলীয় গণতন্ত্র স্থগিত রাখা কোনো সমাধান নয়। বরং এটি বিএনপিকে স্থবির এবং পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। যদি বিএনপি নির্বাচন জয়ের পর পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করে, তাহলে জনগণ মনে করবে, দলটি ক্ষমতা পাওয়ার পরই কেবল সংস্কার করতে চায়, যা দলের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হবে। সত্যিকারের রাজনৈতিক দল কঠিন সময়েও নিজেদের পরিবর্তন আনতে পারে—এটাই রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতার চিহ্ন।
বিএনপির ছাত্র সংগঠন, ছাত্রদল গত ১৭ বছর ধরে সংগঠিত নেতৃত্বের অভাবে ভুগছে। সরকারি দমন-পীড়নের কারণে তারা কার্যকর কোনো কমিটি গঠন করতে পারেনি। এখনই সময় সংগঠনকে পুনর্গঠনের। প্রকৃত ছাত্রনেতাদের সামনে আনা উচিত, শুধু রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্তদের নয়। তাদের টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিতে দেওয়া উচিত, রাজনৈতিক বিতর্কে বিএনপির পক্ষে কথা বলতে দেওয়া উচিত এবং তরুণদের সঙ্গে কার্যকরভাবে সংযোগ তৈরি করতে দেওয়া উচিত। যখন বিএনপির প্রবীণ নেতাদের সাথে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের টকশোতে বিতর্ক করতে হয়, তখন এটি অস্বস্তিকর ও এলোমেলো চিত্র তৈরি করে, যা আত্মবিশ্বাস জাগায় না। বিএনপির এখন সাহসী হতে হবে। মনে রাখতে হবে বেগম খালেদা জিয়া বলতেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে, এবং নতুন নেতৃত্বের চাহিদা এখন অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদি দলটি আর বেশি সময় নেয়, তাহলে আরও নবীন, উদ্যমী রাজনৈতিক আন্দোলন বিএনপিকে পেছনে ফেলে দেবে।
পরিশেষে, বিএনপি একসময় এমন একটি দল ছিল যা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করত, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে এগিয়ে নিত এবং বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তুলত। কিন্তু যদি দলটি অতীতের ভয় ও দ্বিধার মধ্যে আটকে থাকে, তাহলে এটি এমন একটি প্রজন্মকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে, যারা একসময় বিএনপির সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি হতে পারত। শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে বিএনপির উচিত তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে চিন্তা করা। তাদের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়; এটি বিএনপির হারানো শক্তি ফিরে পাওয়ার মূল চাবিকাঠি। যদি দলটি এখনই পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে শুধু বর্তমান রাজনীতিতে নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রেও বিএনপি তার গুরুত্ব হারাবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়