Image description
 

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর নেতাকর্মীরা বিদেশে পলায়ন ও আত্মগোপনে চলে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য ভেতরে ভেতরে নানা কৌশল গ্রহণ করছে দলটি। সরকারি-বেসরকারি যেসব বিভাগে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও ঠুনকো অজুহাতে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে যে অস্থিরতা চলছে এর পেছনে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কলকাঠি নাড়ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের এক সহ সম্পাদক আলাপকালে জানান, আওয়ামী লীগের টার্গেট এখন ক্ষমতা ফিরে পাওয়া নয়। আগের টার্গেট পরিবর্তন করে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করে কাজ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করা এবং এই সরকারের বিরুদ্ধে একটি জনঅসন্তোষ গড়ে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি সব খাতেই পদে পদে অন্তর্বর্তী সরকারকে অসহযোগিতা করা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন ও শ্রমিক অসন্তোষের মাধ্যমে দেশে এমন অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে যাতে অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে কোনো উপদেষ্টা শান্তিতে ঘুমাতে না পারেন এবং কোনো কূল-কিনারা করে উঠতে না পারেন।

 

গত রোববার হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিলসহ ছয় দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা, ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে তাদের অধিভুক্ত থেকে সাত কলেজ বাতিল ঘোষণা করেছে এবং শিক্ষার্থীদের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা দফায় দফায় বৈঠক করে পরিস্থিতি সামাল দেন। এর আগেও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। তখনো পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এর পেছনে ছাত্রলীগের অপেক্ষাকৃত অপরিচিত নেতাকর্মীরা জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে। এরপর নতুন করে শুরু হয়েছে রেলের কর্মচারীদের আন্দোলন। বেতনের সাথে রানিং ভাতা যোগ করে পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধার দাবিতে গতকাল রেলওয়ের কর্মচারীরা সারা দেশে কর্মবিরতি শুরু করলে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রী ভোগান্তি দেখা দেয়। এরপর কমলাপুর রেলস্টেনের ভিআইপি কক্ষে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক হলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় বৈঠক। এ দিকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে চলছে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের আন্দোলন। এ ছাড়াও গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর শাহবাগে চলে বেসরকারি ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে সচিবালয়ের সামনের সড়কসহ আশপাশের এলাকায় গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের আমলে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নানা দাবিতে থেমে থেমে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এই আন্দোলনের পেছনে কোনো না কোনোভাবে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েকজনের ইন্ধন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি এখনো ওই দেশেই অবস্থান করছেন। প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য ভারতকেই ব্যবহার করেন। তাদের ছক অনুযায়ী একটি জুডিশিয়াল ক্যু করার পথে আগালেও পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের দ্রুত পদক্ষেপে তা ব্যর্থ হয়। এরকম আনসার বিদ্রোহ, পোশাক খাতে অস্থিরতা, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাসহ আরো কিছু কর্মকৌশল ব্যর্থ হয়। এখন অন্তর্বর্তী সরকার যখন জুলাই গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তখনই দেশে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত হাজির হচ্ছে একেক গ্রুপ। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট যে, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তারা এখন শেখ হাসিনার বিচার বন্ধ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার জন্য উসকে দিচ্ছেন। আর এটা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা ছাত্রলীগ-যুবলীগের অপেক্ষাকৃত অপরিচিতমুখগুলো।

 

এসব বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, বাহাউদ্দিন নাছিম, মাহবুবউল আলম হানিফ, এস এম কামাল হোসেন, আফজাল হোসেনসহ আরো কয়েকজনের ব্যক্তিগত মোবাইলে কল করলে তা বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার সরকারের পতন ঘটলেও বিদেশে বসেই ভারতের সহায়তায় শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরাও বসে নেই। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য কাজ করছে। এই যে একের পর এক বিভিন্ন লোকজন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আন্দোলন করছে, আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রেতাত্মারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিষয়টিতে সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। তাদের বিচার হতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে সরকারের ব্যাংকিং খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, অস্থির পরিস্থিতিতে প্রশাসনের ভেতর থেকে খুব বড় ধরনের সহযোগিতা অন্তর্বর্তী সরকার যে পাচ্ছে সেটা বলা যাবে না। এমনকি রুটিন কাজগুলোও নিয়মিত হচ্ছে না। যেসব কাজ নিয়মিত সকালে আসবেন, কাজ করবেন, ফাইলে সই করবেন, বিকেলে বাড়ি যাবেন, সেটাও তো নেই। তিনি বলেন, এখন বলতে গেলে বসে বসে শুধু আন্দোলন দেখতে হচ্ছে। মহার্ঘ্য ভাতা, পদোন্নতি, পদায়ন এসব নিয়েই তো দিন চলে যাচ্ছে।