দেশে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা নিয়ে এখন কারও কোনো পদক্ষেপ নেই। এ বিষয় নিয়ে কার্যত সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কোনো ক্যাম্পেইনও চোখে পড়ে না। অ্যাসিড সহিংসতার জন্য অপরাধীর যে শাস্তি হওয়ার কথা, তা-ও দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ-সংক্রান্ত একটি সেল ছিল। সেই সেলটিও এই অপরাধ দমনে এখন আর ভূমিকা রাখছে না। এই সেল দেশব্যাপী অ্যাসিড সন্ত্রাস বিষয়ে মনিটরিং করত। কিন্তু সে নজরদারি এখন শূন্যের কোঠায়। অভিযোগ অনুযায়ী, যারা অ্যাসিডদগ্ধ হন তারা মামলা করার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপেই থানাতে কোনো সহযোগিতা পান না। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতি তিন মাসে এ নিয়ে একটি সভা হওয়ার কথা। ন্যাশনাল অ্যাসিড কন্ট্রোল কাউন্সিল নামের সভাটি সাত-আট বছরেও হয়নি। আবার জেলা প্রশাসকের অধীনে এ বিষয়ে যে সভা হওয়ার কথা, সেটিও কার্যকর না। সব মিলিয়ে দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম পুরোপুরি ঝিমিয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন। অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালে অ্যাসিড নিক্ষেপের মোট ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। এতে মোট ২২ জন অ্যাসিডদগ্ধ হন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশিই নারী। পাঁচ বছর ধরে গড়ে বছরে ২২ থেকে ৩০টির মতো অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।
একসময় শুধু নারীর ওপর অ্যাসিডের মতো ভয়ংকর দাহ্য রাসায়নিক ছুড়ে মারা হতো। এখন অ্যাসিড সন্ত্রাসের হাত থেকে পুরুষ ও শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। আর এই সর্বনাশ করছে কাছের লোকজন। ভুক্তভোগীর স্বামী, প্রাক্তন স্বামী, সৎবাবা, চাচা, প্রেমিক, প্রতিবেশী, আত্মীয়, ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ও সহকর্মীরাই অ্যাসিড ছুড়ে মারছে। অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, পারিবারিক সহিংসতা, জমি নিয়ে বিরোধ, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়াও যৌতুক, যৌন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, বিবাহবিচ্ছেদ, ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সরদার জাহাঙ্গীর হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই অপরাধ দমনে আইনে যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা নিশ্চিত করতে যার যা করণীয় সেটি এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার কারণেই বেশির ভাগ অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান বা কোনো নারীর স্বামী বেকার ও মাদকাসক্ত হলে যৌতুক হিসেবে টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিয়ে তা না পেয়ে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। কোনো নারী বিবাহবিচ্ছেদ চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে সেই নারীর ওপর তার স্বামী অ্যাসিড নিক্ষেপ করে। পারিবারিকভাবে জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেও অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এর আগে ২০২৩ সালে মোট অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১১টি। এতে ১৩ জন দগ্ধ হন। যার মধ্যে নারী ৮ জন, পুরুষ ৩ জন এবং শিশু ২ জন। আর ২০২২ সালে মোট ২৯টি অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় ১৮ জন ঝলসে যায়। এর মধ্যে নারী ১৬ জন, পুরুষ ১১ জন আর শিশু ২ জন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আগের তুলনায় অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা কমলেও সচেতনতার অভাব ও অপরাধীদের শাস্তি কার্যকরের হার আশানুরূপ না হওয়ায় ভয়াবহ এই অপরাধ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া অ্যাসিড সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেপ্তার অপরাধীদের সাজা পাওয়ার হার কম। এমনকি এজন্য সংশ্লিষ্ট আইনে ভুক্তভোগীর যে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা, সেটিও তারা সেভাবে পাচ্ছে না। কিছু কিছু অ্যাসিড-সংক্রান্ত মামলায় সাজা হয়েছে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হচ্ছে আদালতে সাক্ষী হাজির করা। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতাও আছে। এসব মামলায় বিচার কার্যক্রম আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।
রাজধানীর তুরাগে গত বছরের ২১ নভেম্বর একটি বাসায় ঢুকে দুই বছরের শিশু ও তার মায়ের শরীরে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে সোনার চেইন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এতে গুরুতর অবস্থায় আহত শিশু ও তার মাকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া গত বছরের শেষে ২৮ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায় টাকা নিয়ে বিরোধের জেরে এক নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের অভিযোগ ওঠে। এতে সেই নারীর শরীরের নিচের অংশ পুড়ে যায়।