রংপুর সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা শাহজাহান রতন বুধবার দুপুরে সিটি করপোরেশনে যান নাগরিক সনদের জন্য। সেখান থেকে নাগরিক সনদের ফরম কিনে তাকে যেতে হয় রিকশা ভাড়া খরচ করে পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে। তার ওয়ার্ডের নাগরিকসেবার দায়িত্বে রয়েছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি সনদ হাতে পান। শুধু রংপুর সিটিতেই নয়, দেশের ১১টি করপোরেশনের বাসিন্দারা কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর নির্বাচিত মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। সে প্রশাসকও বারবার বদলি হচ্ছেন। তারা নিজ দপ্তরের কাজ শেষে সিটি করপোরেশনে বাড়তি সময় দিতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। আর তারা জনগণের কাছেও জবাবদিহিতা না থাকায় সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিমত নগরবিদের।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নতুন ওয়ার্ডের উন্নয়ন কাজসহ ৫০০ কোটি টাকার চলমান উন্নয়ন কাজে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। জন্মসনদ, উত্তরাধিকার সনদসহ ১৪ ধরনের নাগরিকসেবা পেতে নাগরিকদের বেড়েছে ভোগান্তি। মশক নিধন, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের বেহাল দশায় মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। জনপ্রতিনিধি না থাকায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে পুরো সিটি করপোরেশনে।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছি। শুরুর দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। উন্নয়ন কাজে অন্য সেবা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করার কারণে কিছুটা ধীরগতি হয়েছে। কিন্তু এর অনেক সুফল রয়েছে। এক রাস্তা বারবার কাটতে হবে না এবং নগরবাসীকেও বারবার ভোগান্তি পোহাতে হবে না।’
জন্ম ও মৃত্যুর নিবন্ধন, নাগরিক, চারিত্রিক, ওয়ারিশ, আয়, অবিবাহিত, দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, প্রয়োজন ক্ষেত্রে অনাপত্তিপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকা যাচাইসহ ১৪ ধরনের নাগরিক সেবার জন্য নাগরিককে সিটি করপোরেশনের শরণাপন্ন হতে হয়। আগের রুটিন কাজের সঙ্গে এসব বাড়তি কাজের চাপ বেড়েছে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের ওপর। ফলে বাজার মনিটরিং, অবৈধ উচ্ছেদের মতো রুটিন দায়িত্ব পালনে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
একই অবস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রায় সব কার্যক্রম। প্রশাসকবিহীন সংস্থাটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। একই সঙ্গে নেই সংস্থাটির চার বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তা। এতেই নর্দমা ও খাল পরিষ্কার, মশক নিধন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমসহ সেবামূলক প্রায় সব কাজই থমকে গেছে। ছোটবড় বিভিন্ন রাস্তায় তৈরি হওয়া খানাখন্দ ঠিক করার উদ্যোগ নেই এখনো। কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, মশা বেড়েছে। সঙ্গে এলাকার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে না ঠিকমতো। শুধু প্রশাসকই নয়, করপোরেশনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী পদেও কেউ নেই গত এক মাস ধরে। সর্বশেষ এই পদে অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর তিনি শেষ দিনের মতো অফিস করেছেন। এর পর থেকে এই পদ খালি। পরে সংস্থাটির সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঞাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে খালি রয়েছে প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও নিরীক্ষ কর্মকর্তা। সংস্থাটির সূত্রগুলো বলছে, এসব পদে সরকার অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়ন করে থাকে। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তুলনামূলক নিচের কর্মকর্তাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থবির উন্নয়ন কাজ : সরকার পরিবর্তনের পর আর কাজ শুরু হয়নি আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল খনন ও সংস্কার প্রকল্পে। এ প্রকল্পের কিছু অংশ কাজ হলে বাকিটুকু এখন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ১০তলা বিশিষ্ট বঙ্গবাজার নগর পাইকারি বিপণিবিতানের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডি হ্রদে নজরুল সরোবর, জিয়া শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থাও খারাপ। রাস্তার পাশে, খালের পাশে, ফ্লাইওভারের নিচে, ময়লার ডাম্পিং স্টেশনের সামনে আবর্জনা জমে প্রতিদিনই। কোনো কোনো স্থান থেকে ময়লা পরিষ্কার করা হলেও অবশিষ্ট পড়ে থাকে আরও অনেক আবর্জনা। সেসব ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধের কারণে স্থানীয়দের মুখে রুমাল চেপে চলতে হয়। একই সঙ্গে সংস্থাটির অধীনে থাকা ভাঙাচোরা সড়কগুলো সংস্কারে হাত দেয়নি সংস্থাটি।
ঢাকার বাইরে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর তুলে ধরা হলো :
রাজশাহী : ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই দিন সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরভবন পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। লুট করে নিয়ে গেছে সিটি ভবনের সবকিছুই। এমন পরিস্থিতিতে নগরভবনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসে কাজ করার মতো অবস্থাও ছিল না। নগরীর বিসিক শিল্পনগরী এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার এলাকার রাস্তায় যে সড়কবাতিগুলো আছে সেগুলো কয়েকদিন থেকে জ্বলছে না। একেবারে ভূতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। এ কারণে এলাকায় ছিনতাই-চুরি ও লুটপাট বেড়ে গেছে। নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রায়হান আলী বলেন, ‘ওয়ার্ডের অনেকেই বিভিন্ন দরকারি কাজে কার্যালয়ে এসে ফিরে যাচ্ছেন। সরকারি কর্মকর্তা, যাকে দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি আগে তার অফিস করেন, তার এখানে আসেন। এভাবে পুরো নগরীতেই নাগরিকসেবা ভেঙে পড়েছে।’ রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা নানা কাজে এমনিতেই ব্যস্ত থাকেন। তার ওপর বাড়তি দায়িত্ব দিলে কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। সিটি করপোরেশন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে জনপ্রতিনিধির কাজ সহজ নয়।’
বরিশাল : মেয়রসহ কাউন্সিলর না থাকায় নগর ভবন থেকে দেওয়া নাগরিকসেবা ভেঙে পড়েছে। নগরবাসী তার কাক্সিক্ষত সেবা বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও প্রতিদিন নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জন ভোগান্তি লাগবে প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়ে কোনো সেবা পাচ্ছে না নগরবাসী। নিজেদের দায়িত্ব পালন শেষে বাড়তি সেবা দিতে কর্মকর্তারা তেমন আগ্রহী নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। ধীরগতি, মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে না। অনুন্নত এলাকায় কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাউন্সিলরের সচিব বলেন, দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা কার্যালয়ে এসে বসেন না। কেউ জন্ম-মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্সের জন্য এসে সনদ চাইলেও দিতে পারি না। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কার্যালয় সেবাপ্রত্যাশীদের ভিড়ে ঠাসা থাকে। এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী বলেন, কাউন্সিলররা সবাইকে চিনতেন। তাই তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে সনদ দিতে পারতেন। কর্মকর্তারা তো সবাইকে চিনেন না। তাই তদন্ত করে দিতে একটু দেরি হয়। কাজ চলছে, একেবারে বন্ধ নেই।
সিলেট : জনপ্রতিনিধি না থাকায় নগরবাসী সবচেয়ে বেশি যেসব সেবা নিয়ে ভোগান্তিতে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উত্তরাধিকার সনদ প্রাপ্তি। ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উত্তরাধিকারী সনদে স্বাক্ষর করছেন না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যক্তি ও সাবেক কাউন্সিলর। এ ছাড়া জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুসনদ, প্রত্যয়নপত্র ও ভবনের নকশা অনুমোদনেও শেষ নেই ভোগান্তির। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মুহিত জাবেদ জানান, প্রতি ৩ ওয়ার্ডের জন্য একজন করে সরকারি কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উত্তরাধিকার সনদে স্বাক্ষর করছেন না। বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য ওয়ার্ডের সচিব সপ্তাহে দুই দিন ওই কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। কিন্তু অনেক কাগজপত্রে কর্মকর্তা স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকেন। কাউন্সিলর না থাকায় অনেকে বয়স্ক ভাতা তুলতে সমস্যার শিকার হচ্ছেন। বিদ্যুৎ, পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ সব ধরনের সেবা পেতেই নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, আগে একজন কাউন্সিলরের অধীনে প্রতিদিন ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এখন পাঁচজন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমেও গতি কমেছে। এ ব্যাপারে জানতে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাই রাফিন সরকারকে ফোন দিলে তিনি ঢাকায় ব্যস্ত আছেন, পরে ফোন দিতে বলেন।
খুলনা : ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট খুলনা সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। ৮ ডিসেম্বর তার বদলি হলে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পান নতুন বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার। পাঁচ মাসের মধ্যে সিটি করপোরেশনে শীর্ষ পদে দুজনের দায়িত্ব বদলে প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও নাগরিক সেবায় ধীরগতি দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক সিটি করপোরেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে পূর্বপরিচিত না থাকায় যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। যাচাই-বাছাই কাজে অনেকটা সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশ কাম সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, বিচার শালিসির মতো জরুরি সেবা প্রদান কাজেও বিলম্ব হচ্ছে। সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা নার্গিস আক্তার জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের জন্য সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধনের কাগজ জমা দিতে হবে। কিন্তু দুই তিন দিন ঘুরেও সনদপত্র না পাওয়ায় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করতে পারছেন না।
বরিশাল : মেয়রসহ কাউন্সিলর না থাকায় নগরভবন থেকে দেওয়া নাগরিকসেবা ভেঙে পড়েছে। নগরবাসী তার কাক্সিক্ষত সেবা বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও প্রতিদিন নানা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জন ভোগান্তি লাগবে প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়ে কোনো সেবা পাচ্ছে না নগরবাসী। নিজেদের দায়িত্ব পালন শেষে বাড়তি সেবা দিতে কর্মকর্তারা তেমন আগ্রহী নন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেন, নগরবাসী এসে কার কাছে গেলে সঠিক সেবা পাবে সেই লোক খুঁজে পায় না। জন্ম ও মৃত্যুসনদ, নাগরিকসনদ, ট্রেড লাইসেন্স পাওয়াসহ প্ল্যান পাচ্ছে না নগরবাসী। বর্তমানে টিসিবির স্মার্টকার্ড ও ভোটার হওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক ভোগান্তি। টিসিবির স্মার্টকার্ড এলেও ভুলের কারণে কার্ড পাচ্ছেন না অনেকে।
এ বিষয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল বারী বলেন, কাউন্সিলররা সবাইকে চিনতেন। তাই তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে সনদ দিতে পারতেন। কর্মকর্তারা তো সবাইকে চিনেন না। তাই তদন্ত করে দিতে একটু দেরি হয়। কাজ চলছে, একেবারে বন্ধ নেই।
গাজীপুর : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পসহ সব ধরনের কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। মানুষকে নাগরিক সনদ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সনদ, ওয়ারিশ সনদ, অবিবাহিত সনদ, প্রত্যয়নপত্র, পারিবারিক সনদসহ অন্যান্য সনদ প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। গত ১২ বছরে তিনবার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কোনো নির্বাচিত মেয়রই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ভারপ্রাপ্ত মেয়র দিয়েই বেশির ভাগ সময় এ সিটি পরিচালিত হয়েছে। যার কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বৃহত্তম এ সিটি করপোরেশনের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং বাংলাদেশ কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের ফলে সিটির জনগণ চরমভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। নাগরিক সনদ, মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশ সনদ, মশা নিধন, ডেঙ্গু, সামাজিকভাবে শালিসি বিচার, পাসপোর্ট করা, বিদেশে যাত্রা, ভোটার হালনাগাদ, ভোটার পরিবর্তন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এগুলো সমাধানে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের কোনো বিকল্প নেই।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর না থাকায় সিটি করপোরেশনের সব ধরনের সেবামূলক কাজগুলোতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সিটির বিভিন্ন উন্নয়নকাজ বন্ধ না হলেও চলছে ধীরগতিতে। টিসিবি পণ্য ও কার্ড বিতরণে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ : মেয়র ও কাউন্সিলরবিহীন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) সর্বক্ষেত্রেই যেন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব পালনে অনেক হিমশিম খেতে হচ্ছে। জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেন না। জনপ্রতিনিধিবিহীন তারা যেন নির্বিকার। পুরো নাসিক এলাকাজুড়েই রাস্তাঘাটের কোনো সংস্কার নেই, যানবাহন, দ্রব্যমূল্য ও নাগরিক সুবিধার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, টিসিবি পণ্য বন্ধ হয়ে গেছে ও জন্মসনদে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুতের বাতি নষ্ট থাকলেও ঠিক করার উদ্যোগ নেই।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, কিছুটা তো সমস্যা হচ্ছেই। আমাদের প্রশাসক যিনি আছেন এটা উনার অতিরিক্ত দায়িত্ব। উনার মূল দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় চালাতে হয় আবার এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় এখানে দুই দিন আসেন এর বেশি তিনি আর কী করতে পারবেন। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সিটি করপোরেশনের প্রশাসক এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেন, পরিবর্তিত এ সময় আমাদের কাজ করতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। সব সমস্যা তো একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিটা বিষয়ে আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখেই কাজ করছি।
কুমিল্লা : কুমিল্লা নগরীর ব্যবস্থাপনায় কোথাও শৃঙ্খলা নেই বললে চলে। বর্জ্য ডাস্টবিন উপচে পড়ছে। ফুটপাত দখল উচ্ছেদ, যানজট নিরসনে নেই সমন্বিত উদ্যোগ। নগরীর অশোকতলা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আনিসুর রহমান আখন্দ বলেন, জনপ্রতিনিধি তার এলাকার সমস্যা সম্পর্কে অবগত থাকেন। সেখানে কর্মকর্তা তা বোঝার কথা নয়। তার রুটিন দায়িত্ব জনগণের চাহিদা পূরণ হবে না। সাবেক নারী কাউন্সিলর কোহিনুর আক্তার কাকলী ও সাবেক মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, সড়ক সংস্কার, পরিচ্ছন্নতাসহ নগরীর ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে জনপ্রতিনিধির বিকল্প নেই। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সায়েম ভুইয়া বলেন, আমরা অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। জনপ্রতিনিধি থাকলে কাজে আরও গতি আসবে।
ময়মনসিংহ : রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ময়নসংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) মেয় কাউন্সিলরদের অপসারণের পাশাপাশি অনেক ঠিকাদারও গা ঢাকা দেওয়ায় উন্নয়ন কাজে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। আর এই স্থবিরতা এখন জনদুর্ভোগে রূপ নিয়েছে। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী সুমনা আল মজীদ বলেন, চলমান ৮৬টি প্যাকেজের মধ্যে ঠিকাদারের অনুপস্থিতিসহ নানা কারণে ৮টি প্যাকেজ বাতিল করা হয়েছে। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে যথাসময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।