২০২৩-২৪ অর্থবছরে সমাজসেবা অধিদপ্তরে ভাতার জন্য নতুন করে ৫ লাখ ৩৫ হাজার শারীরিক প্রতিবন্ধীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথম ভাতা পাওয়ার আগেই তাদের প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। এরা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সিস্টেম অ্যানালিস্ট দপ্তর, নগদ ও বিকাশের সার্ভারে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে নতুন ভাতাভোগী প্রতিবন্ধীদের তথ্য চুরি করে। গত বছরের ১১ জুন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে আজল হক (৫৭), কামরুল ইসলাম ওরফে হিরু (২৫) এবং শাকিল (২৩) নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ। এ পরই বেরিয়ে আসতে থাকে সরকারি সার্ভার থেকে তথ্য চুরির ভয়াবহ ঘটনা। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে প্রতারণার শিকার হন ভাতা সুবিধাভোগীরা। তারা ঠাকুরগাঁয়ের রাণীশংকৈল থানায় অভিযোগ করেন। এর পরই তদন্তে নামে পুলিশ।
জানা গেছে, গত বছরের ১ জুন থেকে তৎকালীন সরকার নতুন করে ৫ লাখ প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ভাতাভোগীদের বিকাশ-নগদের মাধ্যমে এক বছরের ভাতা ১০ হাজার ২০০ টাকা করে প্রদান করে। প্রতারক চক্রটি কৌশলে ওই তালিকা চুরি করে নেয়। অথচ এই তালিকা সমাজসেবা অধিদপ্তর, সোনালী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদে সংরক্ষণ করা ছিল। এই তালিকা সংগ্রহের পর প্রতারকরা নিজেদের সমাজসেবা অফিসার পরিচয় দিয়ে ব্রিলিয়ান্ট অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের ফোন করে ভাতা পাঠানোর নামে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) জেনে নেয়। এভাবে সারা দেশের শতাধিক প্রতিবন্ধীর টাকা হাতিয়ে নিতে থাকে তারা। এই প্রতারক চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মোবাইল ফোন, সিম, বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের কিট, অর্থ লেনদেনের রেকর্ডপত্র ও সিপিইউ জব্দ করা হয়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সমাজের দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সরকারের একটি বিশেষ অগ্রাধিকার খাত। দেড় কোটির বেশি জনগোষ্ঠী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাভুক্ত।
ঠাকুরগাঁও জেলার তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (রাণীশংকৈল সার্কেল) ফারুক আহমেদ এ প্রতিবেদককে জানান, চক্রটি প্রথম ধাপে প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতাভোগীদের তালিকা উপকার ভোগীদের তালিকা সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় ধাপে প্রতারকরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে ব্রিলিয়ান্ট অ্যাপস দিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীদের ফোন করে নিজেদের সমাজসেবা অধিদপ্তরের লোক পরিচয় দেয়। এর পর অভিনব কায়দায় ভাতাভোগীদের কাছ থেকে ওটিপি সংগ্রহ করে। এর পরই ভাতাভোগীদের বিকাশ কিংবা নগদ হিসাবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় চক্রটি। তৃতীয় ধাপে নির্দিষ্ট বিকাশ অথবা নগদ এজেন্ট হিসাবে টাকা ক্যাশ আউটের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নেয়।
এ বিষয়ে কথা হয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রতিবন্ধী ভাতা) নূরুল হক মিয়ার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, সারা দেশে মোট ভাতাভোগী প্রতিবন্ধী প্রায় ২৯ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন ভাতাভোগী হিসেবে যোগ হয় ৫ লাখ ৩৫ হাজার। এদের তথ্য চুরি করে সারা দেশের ভাতা ভোগীদের কিছু অংশের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। এ ঘটনায় তারা তদন্ত করেন। কিন্তু চুরিতে সহায়তাকারীদের শনাক্ত করতে পারেননি।
তিনি বলেন, যারা প্রতিবন্ধী কার্ডধারী তারাই উপজেলা পর্যায়ে কিংবা অনলাইনে ভাতার জন্য আবেদন করেন। এর পর তা যাচাই-বাছাই করে উপজেলা থেকেই অধিদপ্তরে আসে। অধিদপ্তর সেগুলোর তালিকা প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়। তালিকায় কারও নাম থাকে না, ভাতাভোগীদের শুধু মোবাইল নম্বরগুলো থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর জন্য সোনালী ব্যাংকে এবং বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য ব্র্যাক ব্যাংকে তালিকা সরবরাহ করে। তবে মোট টাকার ৭০ ভাগ যায় নগদ অ্যাকাউন্টে এবং ৩০ ভাগ যায় বিকাশ অ্যাকাউন্টে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত বছর শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই ভাতাভোগী অন্তত ৭০০ প্রতিবন্ধীর তথ্য চুরি হয়। এর পর তাদের অ্যাকাউন্ট বদল করা হয়। অর্থাৎ প্রকৃত ভাতাভোগীদের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে প্রতারক চক্রের নির্দিষ্ট মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করা হয়। ওইসব মোবাইল নম্বর টাকা যাওয়ার আগেই তা জানাজানি হয় এবং অ্যাকান্টগুলো ঠিক করা হয়। এর পরই সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবছর একবার ভাতাভোগীদের সরাসরি যাচাইয়ের নীতিমালা করেছে।
আরও জানা যায়, ঢাকার ধামরাই উপজেলায় মৃত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে তিন বছর ধরে ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযুক্ত ছবুর আলী উপজেলার বাইশাকান্দা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দক্ষিণ আনালিয়াখোলা গ্রামের মৃত তাইজ উদ্দিন আলীর ছেলে আলাল মিয়া শারীরিকভাবে পঙ্গু হওয়ায় ২০১৬ সালে তাকে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে একটি অসচ্ছল প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়। সেই থেকে আলাল প্রতি তিন মাস পর পর কৃষি ব্যাংক ধামরাই শাখায় টিপসই দিয়ে টাকা তুলতেন। ৫ বছরে তিনি ৩১ হাজার ২৫০ টাকা তোলেন। এর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে এসে টাকা মোবাইল নম্বরে পাঠানো হবে বললে আলাল মিয়া তার চাচাতো ভাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছবুর আলী মোবাইল নম্বর দিয়ে দেন। তখন থেকে ভাতার টাকা ওই নম্বরে পাঠানো হতো।