Image description
দলে দলে ভাঙন, একসময়ের মিত্ররা এখন বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ

বিএনপি জোটের বিগত সরকারবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘকালের শরিক এলডিপি অবশেষে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনি জোটে যোগ দিয়েছে। এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে লড়বেন বিএনপির বিরুদ্ধে। শুধু অলি আহমদ নন, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলামের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) নির্বাচন করবে জামায়াত জোট থেকে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান তাঁদের নির্বাচনি জোটবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তবে রাত ৮টায় দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এনসিপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে। এদিকে জামায়াত জোটে যাওয়া নিয়ে এনসিপিতে দেখা দিয়েছে সংকট। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।

অপরদিকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিতে চলছে উৎসবের আমেজ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সশরীরে দেশের মাটিতে পেয়ে উজ্জীবিত নেতা-কর্মীরা নির্বাচনি প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন। নির্বাচনি সমঝোতা হলেও এবার নিবন্ধিত দলকে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে ভোট করার বিধান থাকায় কয়েকটি অনিবন্ধিত দল নিজেদের সংগঠন বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করছে। আবার নিবন্ধিত দলের শীর্ষ নেতারাও নিজ পদ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন। এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে নিবন্ধিত দলের মতবিরোধও বাড়ছে। সব মিলিয়ে রাজনীতি এখন রাজনীতিকেন্দ্রিক। পাল্টে গেছে অতীতের সব নির্বাচনি সমীকরণ।

জানা গেছে, গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমমনা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এই ছয়টি দল আসন সমঝোতার ভিত্তিতে সব আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার আলোচনা শুরু করে। পরে এতে যোগ দেয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এই আটটি দল বিভিন্ন দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে টানা অনেক দিন মাঠে ছিল। নতুন করে এনসিপি ও এলডিপি

নির্বাচনি সমঝোতায় যুক্ত হওয়ায় এখানে দলের সঙ্গে সংখ্যা দাঁড়াল ১০টিতে। এই ১০ দলের অধিকাংশই একসময় বিএনপির সঙ্গে রাজপথে থেকে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। একসময়ের মিত্র দলগুলোই আগামী নির্বাচনে বিনপির প্রধান প্রতিপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে সংকটে পড়েছে এনসিপি। দলের নীতিনির্ধারণী কেন্দ্রীয় নেতা তাসনিম জারা, তাজনূভা জাবীন, মনিরা শারমিনসহ পর্ষদের একাধিক নেতা ইতোমধ্যে পদত্যাগপত্রও জমা দিয়েছেন। এ ছাড়াও দলের ৩০ জন নেতা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে আপত্তি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এদের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন।

এদিকে বিগত যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের জন্য এখন পর্যন্ত ১৫টি আসন নিশ্চিত করেছে বিএনপি। এর মধ্যে ছয়টি দল ছাড়া অন্য শরিক দলের নেতারা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন। এ জন্য চারটি দলের প্রধান নেতারা ইতোমধ্যে নিজ দল বিলুপ্ত করে নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। আরও দুটি দলের মহাসচিব দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন।

এর মধ্যে বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ ভোলা-১ (সদর) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি দলের ‘গরুর গাড়ি’ প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আন্দালিব রহমানকে ঢাকা-১৭ (গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট) আসনে প্রার্থী করার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপির সিনিয়র নেতারা এ আসনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নির্বাচন করার অনুরোধ জানান। গতকাল তারেক রহমানের পক্ষে এই আসনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আন্দালিব রহমান ভোলা-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতা করলেও ছয়টি দল নিজ নিজ দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলগুলো হলো নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। ইতোমধ্যে পাঁচদলীয় মোর্চা ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’-এর তিন শীর্ষ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক ও জোনায়েদ সাকিকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-২), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক (ঢাকা-১২) ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬) আসনে নির্বাচন করবেন। মাহমুদুর রহমান দলীয় প্রতীক কেটলি, সাইফুল হক কোদাল ও জোনায়েদ সাকি মাথাল প্রতীকে লড়বেন। এ ছাড়া গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে বিএনপি পটুয়াখালী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তিনিও দলীয় ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করবেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে চারটি আসনে বিএনপির সমঝোতা হয়েছে। আসন চারটি হলো-সিলেট-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, নীলফামারী-১ ও নারায়ণগঞ্জ-৪। সিলেট-৫ আসনে নির্বাচন করবেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ উবায়দুল্লাহ ফারুক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, নীলফামারী-১ আসনে মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে যুগ্ম মহাসচিব মুফতি মনির হোসেন কাসেমী প্রার্থী হবেন। নির্বাচনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে নিজ দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন দুজন নেতা। তাঁদের একজন বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, অন্যজন বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। দুজনই যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ছিলেন। শাহাদাত হোসেনকে লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে, সৈয়দ এহসানুল হুদাকে কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর ও নিকলী) আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

এ ছাড়া ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজও বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর, আদাবর) আসনে ধানের শীষ প্রতীকে লড়বেন। বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় দল ও এনডিএমের নিবন্ধন নেই।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এককভাবে নির্বাচনি মাঠে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে না পারার বাস্তবতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত এসেছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের সমীকরণ ও সংগঠনের দুর্বলতাও এতে প্রভাব ফেলেছে। শরিক দলের নেতাদের কারও কারও আশঙ্কা, নিজস্ব প্রতীকে ভোট করলে প্রতিপক্ষ সুবিধা পেয়ে যেতে পারে। সে কারণে তাঁরা ধানের শীষকেই নিরাপদ প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও বাস্তবতা বিবেচনায় এ ব্যাপারে শরিকদের উৎসাহিত করছে। এখনো সে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এই কৌশল মাঠপর্যায়ে প্রার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় বিএনপির শরিক দলগুলোর অনেক নেতা ধানের শীষ প্রতীকে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উজ্জীবিত বিএনপির লক্ষ্য এখন নির্বাচন : দীর্ঘদিন পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং ঢাকায় তাঁর সংবর্ধনা সমাবেশে নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ জনসাধারণনের অভূতপূর্ব উপস্থিতির প্রভাব মাঠপর্যায়ে পড়ছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলের প্রধান নেতৃত্বের বাংলাদেশে সরাসরি অনুপস্থিতিজনিত যে শূন্যতা তৃণমূলে অনুভূত হচ্ছিল, সেটিও কেটে গেছে। তাঁরা ঢাকা থেকে উজ্জীবিত হয়ে এলাকায় ফিরে গেছেন। এই উদ্দীপনা ভোটের মাঠে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশা করেন বিএনপির সর্বস্তরের নেতারা। দলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, তারেক রহমান মনোনয়নপত্র দাখিল করাসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেবেন।

এরপর দলীয় এবং সমমনা প্রার্থীদের নির্বাচনি প্রচারে তাঁর যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী শিগগিরই তারেক রহমানের বগুড়া ও শ্বশুরবাড়ি সিলেটে যাওয়ার কথা রয়েছে।

তিনি সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করবেন। আর বগুড়া তাঁর নির্বাচনি এলাকা। তিন দিনের জন্য তিনি বগুড়ায় যেতে পারেন বলে জানা গেছে।