দেশের ক্ষমতায় তখন ‘ওয়ান ইলেভেনের’ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সামনে একটি নির্বাচন, জনমনে গণতন্ত্রে ফেরার আকাঙ্ক্ষা। তেমনই এক পরিস্থিতিতে কারামুক্ত হয়ে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
১৭ বছর পর তিনি যখন দেশে ফিরছেন, তখনো দেশের ক্ষমতায় একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার; ভোট দেওয়ার, গণতন্ত্রে ফেরার আশা নিয়ে নির্বাচনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের মানুষ।
২০০৮ সালে তারেক যখন পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে গেলেন, শোনা গিয়েছিল তিনি ‘আর রাজনীতি না করার মুচলেকা’ দিয়েছেন। গত ১৭ বছরে রাজনীতি তিনি ঠিকই করেছেন, তবে সেটা লন্ডনে বসে। বৃহস্পতিবার দুপুরে যখন তিনি ঢাকার মাটিতে পা রাখবেন, এই বাংলাদেশ অনেকটাই বদলে গেছে।
আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে রাজনীতি, অর্থনীতি আর অবকাঠামোতে বড় পরিবর্তন এসেছে। আরো বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান, যা আওয়ামী লীগের সরকারকে উৎখাত করেছে, তারেকের দল বিএনপির সামনে খুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
তারেকের ফেরা না ফেরা নিয়ে ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। ছিল চায়ের টেবিলে আলোচনা, টেলিভিশনের টক শোতে বিতর্ক। বাংলাদেশ সময় বুধবার মধ্যরাতে তিনি লন্ডন থেকে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা পর সব জল্পনার অবসান ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার দু্পুরে তারেকের ফ্লাইট ঢাকায় নামবে। তার সঙ্গে দেশে ফিরবেন স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান। আর থাকবে জাইমার পোষা বিড়াল ‘জেবু’।
তারেক রহমান ফিরছেন, তা নিয়ে নেতা-কর্মীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তারা আসতে শুরু করেছেন ঢাকায়। ভোটের আগে বিরাট জমায়েত ঘটিয়ে, তারেকের জন্য নজিরবিহীন সংবর্ধনার আয়োজন করে দেশবাসীকে একটি বার্তা দিতে চাইছে বিএনপি।
নীলফামারীর টুনিহাটের বিএনপি কর্মী মমিন মিয়া বুধবার সকালেই ঢাকায় এসেছেন তারেক রহমানকে একনজর দেখার ইচ্ছা নিয়ে।
চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি বললেন, “কি যে খুশি লাগছে, বুঝাতেই পারমু না। তিনি আমাদের গর্ব। দেইখেন, লিডার এই বাংলাদেশকে বদলে দিবে।”
বাংলাদেশ যে নানা কারণেই বদলে যাচ্ছে, দেশের মানুষও তা টের পাচ্ছে। প্রশ্ন হল, তারেক সেই পরিবর্তনের গতিমুখ কোন দিকে নিয়ে যাবেন।
রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহানের ভাষায়, “দিস ইজ দ্য টাইম ফর হিম টু বিকাম দ্য রিয়েল স্টেটসম্যান। উনি যদি কোনো বিভাজনের দিকে যান, তাহলে সেটা আরো সমস্যা তৈরি করবে।”
যা যা আয়োজন
# লন্ডন থেকে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২০২ ফ্লাইটটি ঢাকায় পৌঁছাবে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে, এই ফ্লাইটে আসছেন তারেক রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
# বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানাবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
# ভিআইপি লাউঞ্জের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বুলেট প্রুফ মার্সিডিজে চড়ে তারেক রহমান যাবেন জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ের (তিনশ ফিট সড়ক) কাছে সংবর্ধনার অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে মঞ্চে উঠে নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।
# এই ভাষণ যাতে সকলে দেখতে পায়, সেজন্য ৩০টি এলএডি স্ক্রিন বসানো হয়েছে। থাকছে ৯ শতাধিক মাইক। গুলশান, বনানী, বিমান বন্দর, যুমনা ফিউচার পার্ক পর্যন্ত বিলবোর্ডে বড় পর্দায় তারেকের প্রত্যাবর্তন ও বক্তৃতা দেখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
# বিএনপি, বিএনপি মিডিয়া সেল এবং আওয়ার বিএনপি– এই তিনটি ফেইসবুক পেইজে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হবে।
# আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির আন্দোলনের শরিক নেতাদের পাশাপাশি চব্বিশের অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতাদের সংবধর্না অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মঞ্চে তারাও তারেক রহমানের সঙ্গে থাকবেন।
# সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সারাদেশ থেকে লোকজন ঢাকায় আসছে গত দুই দিন ধরে। সেজন্য দলের পক্ষ থেকে নয়টি বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে বুধবার রাতে এবং বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় পৌঁছাবে এসব ট্রেন।
# সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষ করে তারেক রহমান তার মা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে যাবেন। বসুন্ধরার এই হাসপাতালে গত ২৩ নভেম্বর থেকে ভর্তি আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
# এভারকেয়ার থেকে পরে তারেক রহমান এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যাবেন গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায়। সেখানেই তারা থাকবেন।
# তারেক রহমানের জন্য সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিএনপির বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বুলেটপ্রুফ গাড়ির চারপাশেও থাকবে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
# পূর্বাচলে তিনশ ফুট সড়কে যে সংবর্ধনা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, তার চারপাশে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকবে বলে জানিয়েছেন তারেক রহমানের নিরাপত্তা টিমের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম শামসুল ইসলাম।
# এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীদের ধানের শীষ প্রতীক সঙ্গে না রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নেতা-কর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন- প্ল্যাকার্ড বহন করতে পারবেন। কোনোভাবে নির্বাচনি প্রতীক কেউ নিয়ে আসবেন না।
‘দেড় যুগের নির্বাসিত জীবন’
দেশে তখন জরুরি অবস্থা, ক্ষমতায় সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী।
তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১৩ মামলা। যৌথ বাহিনীর হেফাজতে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তারেক রহমানকে ভর্তি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
এক বছর পর, ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের জামিনে মুক্তি পান তারেক। সেই রাতেই স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য’ লন্ডনে চলে যান তিনি। শুরু হয় নির্বাসিত জীবন।
এদিকে দেশে শুরু হয় বিএনপির দুঃসময়। ২০১০ সালে শহীদ মইনুল সড়কের বাসা থেকে উৎখাত হন তারেকের মা খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি সংসদের বাইরে চলে যায়, রাজপথই হয় দলটির ঠিকানা।
তবে বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারেনি বিএনপি। ২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যু হয়, যা ছিল তার জন্য বড় ধাক্কা। সেই বৈরী সময়েও তারেক দেশে ফিরতে পারেননি।
এর মধ্যে তার পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। কয়েক ডজন মামলার আসামি তারেক তখন আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক। তার পাসপোর্ট আর নবায়ন করা হয়নি। এক সময় শোনা যায়, তারেক যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সময়ে তারেকের বিরুদ্ধে আরো ৭২টি মামলা হয়। সব মিলিয়ে ৫টি মামলায় তার সাজার রায় আসে। এর মধ্যে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় জজ আদালত। হাই কোর্ট বাংলাদেশে তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে যেদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হলে, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর গত সাত বছর ধরে লন্ডন থেকে ভিডিও কলেই তিনি দল চালাচ্ছেন। আর দেশে ঝড়-ঝাপটা সামলে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
তারেকের নির্বাসিত জীবন সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, “সেই জীবন যেমন ছিল কষ্টের, তেমনি চ্যালেঞ্জের। আমাদের নেতা রাত নেই, দিন নেই, ঘণ্টা নেই অবিরাম কাজ করেছেন প্রবাসে থেকে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য।
“আমরাও আমাদের নেতার অপেক্ষায় আছি। তিনি যেমন নির্বাসিত ছিলেন দেড় যুগ, আমিও ছিলাম ৯ বছর। সেজন্য আমি প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে অনুধাবন করি নির্বাসিত জীবন কত কষ্টের, কত বেদনার।”
২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখা যায়নি।
৫ অগাস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেন। পরে উচ্চ আদালতও তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।
আওয়ামী লীগের আমলে দেওয়া বিভিন্ন রায়ে তারেকেরও সাজা হয়েছিল। সেসব মামলায় তারেকও খালাস পান। তাতে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, “মামলাগুলো প্রত্যাহারের ব্যাপারে সরকারও তারেক রহমানকে প্রস্তাব দিয়েছিল। তার একজন আইনজীবী হিসেবে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে চাইলেও বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের মামলা প্রত্যাহারের পরে সবশেষ নামটার যেন তার থাকে।
“তিনি চাইলেই মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিটি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।”
তারপরও অজ্ঞাত কারণে তারেকের দেশে ফেরা হচ্ছিল না। এ বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। সেখানে দীর্ঘদিন পর ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়। চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া দেশে ফিরলেও তারেক ফেরেননি।
ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গেলে সেখানে তার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই তারা একমত হন, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ‘শিগগিরই’ ফিরবেন। তবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ তারা বলতে পারছিলেন না।
এর মধ্যে বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আংশিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। সেখানে জানানো হয়, বগুড়া-৬ আসনে প্রথমবারের মত ভোট করবেন তিনি। ওই ঘোষণার পর তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা জোরালো হয়।
২৩ নভেম্বর ফের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। এ অবস্থায় তারেক কেন ফিরছেন না, সেই প্রশ্ন আবার সামনে আসে।
২৯ নভেম্বর তারেক রহমানের এক বক্তব্যের পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “এমন সঙ্কটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মত আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সকলের মত এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”
তারেক রহমানের দেশে ফিরতে বাধা কোথায়, সেই প্রশ্ন তখন জোরেশোরে উঠতে থাকে। তিনি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন কি না, সেখানে তার ‘স্ট্যাটাস’ কী, সেসব প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারেক রহমানের পাসপোর্ট নেই, তবে তিনি চাইলেই ট্র্যাভেল পাসের ব্যবস্থা করা হবে।
অসুস্থ খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হলেও তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে গত ১২ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘোষণা দেন, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ ডিসেম্বর দেশে আসবেন।
দেশে ফেরার প্রস্তুতিতে এক দিনেই লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে ট্রাভেল পাস পেয়ে যান তারেক রহমান। তার জন্য ঢাকায় বাসা ও অফিস গোছানোর খবর আসে। মির্জা ফখরুল বলেন, বিমানবন্দরে তাদের নেতাকে এমন সংবর্ধনা দেওয়া হবে, যা আগে কোনো রাজনীতিবিদ পাননি।
বিজয় দিবস উপলক্ষে গত মঙ্গলবার লন্ডনের সিটি প্যাভিলিয়নে লন্ডন বিএনপির আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারেক রহমান। সেই অনুষ্ঠান কার্যত তার বিদায় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
প্রবাসী বিএনপিকর্মীদের উদ্দেশে তারেক বলেন, “২৫ তারিখে ইনশাআল্লাহ আপনাদের দোয়ায় আমি দেশে ফিরে যাব। সকলের কাছে দোয়া চেয়ে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে দোয়া করবেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করবেন।”
‘ভোট করবেন বগুড়ায়’
বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারেক রহমান নির্বাচন করবেন তার মায়ের পুরনো আসন বগুড়া-৬ থেকে। দেশে ফেরার পর তিনি ভোটার হবেন। এর আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তার হয়নি।
দেশে ফিরে তিনি নিয়মিত অফিস করবেন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। সেই ভবনে দোতলায় একটি কক্ষ নতুনভাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানে জন্য সাজানো গুছানো হয়েছে। নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও দোতলায় চেয়ারপারসনের কক্ষের পাশে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের চেম্বার করা হয়েছে।
তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় নতুনভাবে রং করে গোছানো হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষে গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের ১০/সি বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে বিএনপির অফিস হিসেবে। চারতলা এই ভবনে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে দোতলায় রয়েছে ব্রিফিং রুম। অন্যান্য তলায় বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে গবেষণা সেল।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন বলেন, “এটি বিএনপির একটি কার্যালয়। এখান থেকে নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।”
উজ্জীবিত বিএনপি
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘিরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সড়ক ও সড়ক মোহনায় তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়ে টানানো হয়েছে ব্যানার, পোস্টার।
সেসব ব্যানারের ছবিতে হাত উঁচু করে অভিবাদন জানাচ্ছেন তারেক রহমান। লেখা আছে, ‘লিডার আসছে…’, ‘ তারেক রহমানের আগমন, গণতন্ত্রের জাগরণ’, ‘সবার রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’. ‘দিকে দিকে আজ একটাই সুর, একটাই গান, বাংলাদেশের প্রাণ তারেক রহমান’, ‘তারেক রহমান আসছে, জাগছে আশা মনে-প্রাণে’।
তারেক রহমানের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসছেন যুব দলের নেতা শফিকুল রহমান।
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, তারেক রহমান এতদিন বিদেশে ছিলেন, এমন একটি গণতান্ত্রিক দেশে ছিলেন, যে দেশকে বলা যায় গণতন্ত্রের পীঠস্থান। সেখানে উনি বহু কিছু শিখেছেন, সেগুলো লিডার হিসেবে এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করবেন।
“আমি দেশ গড়ার পরিকল্পনার কর্মশালায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলাম। আমাদের নেতার চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। আমার লিডারই পারবেন দেশের সব কিছু একটা জায়গায় নিয়ে আসতে।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সানজীদা খাতুনের মতে, নির্বাসিত জীবনে তারেক রহমান নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন। সে কারণে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনতে পারবেন।
“যেমন ধরুন, তারেক রহমান দেশ গড়ার যে পরিকল্পনা তৈরি করেছন, তা যদি একটু বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন প্রতিটি পরিকল্পনা শুধু পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের কাজগুলো বলা হয়েছে স্টেপ বাই স্টেপ। আমি আশা রাখি তারেক রহমান এটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এবারের নির্বাচনে তারেক রহমানই আমাদের নেতা। তার পরিচালনায় আমরা নির্বাচনি বৈতরণী পার হব অত্যন্ত সফলতার সাথে। জনগণের ম্যান্ডেট পেলে যে সরকার হবে, তারও নেতা হবে তারেক রহমানই।
“তিনি দীর্ঘ এক যুগ নির্বাসনে থাকলেও দলের সাথে, কর্মীদের সাথে, নেতাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে সব সময়। দল পরিচালনায় তিনি নিজেই তার প্রমাণ রেখেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, তার নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।”
বিভাজিত দেশকে এক করতে পারবেন তারেক?
সবচেয়ে বেশি সময় বাংলাদেশ শাসন করা দুই নেত্রীর একজন শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে নির্বাসনে আছেন। আরেকজন খালেদা জিয়া অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে কার্যত দূরে।
চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে নতুন মেরুকরণ, নতুন বিভাজন।
আওয়ামী লীগহীন ময়দানে জামায়াতে ইসলামী এখন নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ক্ষমতা থেকে দূরে সাড়ে ১৭ বছরে বিএনপির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা মারা গেছেন, অনেকে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। বিএনপির মত সব দলেই এখন নতুনদের জায়গা করে দেওয়ার সময়।
এমন বাস্তবতায় নির্বাসন ভেঙে দেশে ফিরে তারেক রহমান আদৌ রাজনীতিতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন?
রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান মনে করেন, তারেক রহমানের সামনে সে সুযোগ রয়েছে।
“এখন প্রশ্ন হতে পারে কীভাবে পারবেন? আমরা এই গত ১৮-১৯ তারিখে যেসব ঘটনা দেখলাম (সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ) এবং রাইট উইংয়ের যে উল্লম্ফন আমরা দেখলাম এবং তার ফলশ্রুতিতে ইলেকশন হবে কি হবে না- এটা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা আছে, আমার ধারণা উনার আসাটা এবং এসে তার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া, সেই অনিশ্চয়তা কাটানোর ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করবে। এবং এর ফলে অস্থিরতা যেটা আছে, তার ওপর একটা পজিটিভ ইমপ্যাক্ট পড়বে।”
তবে সেক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে কিছু স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও নাগরিক কোয়ালিশনের সদস্য শাহান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যদি তিনি স্থিতিশীলতা চান, তাহলে নির্বাচনের পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংস্কারের যে বিষয়গুলো আছে, যেখানে সবাই একমত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
“মবোক্রেসি খুব বাড়াবাড়ি লেভেলে চলে গেছে। এখানে তিনি যদি শক্ত বার্তা পাঠাতে পারেন যে সরকারকে আসলে সরকারের ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সকল রাজনৈতিক দল যদি সরকারকে সবধরনের সহায়তা করে যে এ ধরনের কাজকে আর কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, প্রেসার গ্রুপ বলা–এ রকম জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে… এই ধরনের একটা শক্ত মেসেজ যদি উনি দিতে পারেন, আই থিঙ্ক দ্যাট উইল ক্রিয়েট আ লট অফ কনফিডেন্স অ্যান্ড আমার মনে হয় সেটা পজিটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলবে।”
বিএনপির সর্বশেষ শাসনামলে হাওয়া ভবনের কলঙ্ক মুছতে তারেককে মনোযোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে নিজের দলের অপকর্ম ঠেকাতেও তাকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।
আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, “তিনি যদি এমন একটি অবস্থা দেখাতে পারেন যে তিনি কেবল জনগণের কথা শোনেন। তাহলে তার দল নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। কিন্তু যদি তাদের (দলের কর্মীদের) কাছে মনে হয় যে তারেক রহমান ইজ স্টিল উইক বা তারেক রহমানের কথাবার্তাগুলো ওইভাবে রেজোনেট হচ্ছে না, তাহলে আই থিঙ্ক ক্রাইসিস আরও বাড়বে।”
এই বিশ্লেষকের মতে, তারেক রহমানের কার্যকর পদক্ষেপ ও দক্ষতার ওপর কেবল তার দলের রাজনীতি নয়, পুরো দেশের রাজনীতির গতিপথ এখন নির্ভর করছে।
এই চ্যালেঞ্জ তারেক রহমান নিতে পারবেন বলেই মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান।
তিনি বলেন, “উনি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করতে পারবেন আশা করি। তাহলে নির্বাচন হবে। শুধু বিএনপি নয়, পুরো দেশ উপকৃত হবে তার উপস্থিতিতে। তা না হলে আমাদের মধ্যে এক দেড় বছরে বৈচিত্র্যের নামে যে বিভাজন, সেটা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আব্দুল আলীম মনে করেন, দেশে আসার পর ভোটের দিকেই বেশি নজর দেবেন তারেক রহমান। তবে ভোটের কাজের বাইরে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
“দলগুলোর মধ্যে যে বিভক্তি, হয়ত এখানে উনি একটা রোল প্লে করতে পারেন। অর্থাৎ সব দলকে একটা জায়গায় এনে ঐকমত্যের সূচনা উনি তৈরি করতে পারেন, যেটা খুব দরকার।”
তারেক রহমানের দেশে ফেরা দেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, “দেশে না থাকার কারণে তিনি যে স্বপ্নগুলো দেখেছেন, প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। বিএনপিকে কেন্দ্র করে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হবে মানুষ।”