নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে নাটকীয়তা যেন শেষই হচ্ছে না। শুরুতে শিল্পপতি মাসুদুজ্জামানকে এ আসনে মনোনয়ন দেয় দলটি। এরপর তিনি সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও পরে সমর্থকদের চাপে আবার নির্বাচনে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তিনি নির্বাচনে ফিরে আসার পর দিন ২০ ডিসেম্বর এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বলে দাবি করেন মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খান। এর চার দিনের মাথায় গতকাল বুধবার এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার দাবি করেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। যদিও কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
গত ৩ নভেম্বর আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এ সময় নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সাবেক সভাপতি মাসুদুজ্জামানকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও চারজন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁর বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। তারা হলেন, মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু, এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম এবং শিল্পপতি আবু জাফর আহমেদ বাবুল।
এক পর্যায়ে চারজনের মধ্যে একজন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু দলীয় প্রার্থী মাসুদুজ্জামানের পক্ষে অবস্থান নেন। মাসুদুজ্জামানও ধানের শীষের পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন প্রচার কৌশল ব্যাপক আলোচনাও তৈরি করে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি হঠাৎ নির্বাচন করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এর কারণ হিসেবে তিনি ‘নিরাপত্তা ও পরিবারের আপত্তি’র কথা বলেন। এতে তাঁর সমর্থক নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁকে নির্বাচনে ফেরাতে তারা একের পর এক কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। এই দাবিতে ১৯ ডিসেম্বর মাসুদুজ্জামানের গার্মেন্টস ঘেরাও করেন সমর্থকরা। এ অবস্থায় তিনি নির্বাচনে ফেরার ঘোষণা দেন।
এর পরদিনই (২০ ডিসেম্বর) নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানান মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাখাওয়াৎ হোসেন খান। তাঁর এ দাবির চার দিনের মাথায় গতকাল একই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার কথা জানান সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম। ‘মনোনয়ন’ পাওয়ার পরে তিনি নারায়ণগঞ্জের বন্দরে কদমরসুল দরগা জিয়ারত করেন। তাঁকে নিয়ে বন্দর এলাকায় আনন্দ মিছিলও বের করেন তাঁর কর্মী সমর্থকরা। এ সময় আবুল কালামের পাশেই ছিলেন আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী শিল্পপতি আবু জাফর বাবুল।
‘মনোনয়নপ্রাপ্তির’ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে মোবাইল ফোনে কল করলে রিসিভ করেন তাঁর ছেলে আবুল কাওসার আশা। তিনি জানান, তাঁর বাবার গলা বসে গেছে। তাই কথা বলতে পারছেন না। দল থেকে তাঁর বাবাকে মনোনীত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে অন্যদের দাবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আবুল কাওসার আশা বলেন, অন্যদের দাবিও ঠিক ছিল। প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল মাসুদুজ্জামানকে। উনি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খানকে। এখন দেওয়া হয়েছে আমার বাবাকে। আবুল কাওসার তাঁর বাবাকে দেওয়া দলীয় মনোনয়নের ফরমও তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। এ আসনে ৩ নভেম্বর দলের মনোনয়ন পাওয়া মাসুদুজ্জামানকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি আমার সমর্থক নেতাকর্মীদের বলেছি আমার ওপর আস্থা রাখুন। খুব দ্রুতই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান হবে। তারা তাদের প্রশ্নের জবাব পাবেন। ধানের শীষের পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকুন।
নগরীর খানপুরের বরফকল মাঠে মাসুদুজ্জামানের নির্বাচনী কার্যালয়। গতকাল রাতেও এ কার্যালয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে জমজমাট ছিল। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়কে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল রাত ১১টায় মাসুদুজ্জামান ও তাঁর সমর্থকদের রওনা হওয়ার কথা। সন্ধ্যা থেকে কার্যালয়ে সেই প্রস্তুতি চলছিল।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী সংক্রান্ত
কোনো ঘোষণা বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে গতকালও দেখা যায়নি। যদিও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন জোট প্রার্থী মুফতি মনির হোসাইন কাসেমীকে ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণাটি সেখানে রয়েছে।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ- ১, ২, ৩-এ বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ বিএনপি তাঁর শরিক দলের প্রার্থীকে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু নারায়ণগঞ্জ-৫ এ আমরা দেখলাম প্রথমে মাসুদুজ্জামানকে মনোনয়ন দিয়েছে। এরপর দেখলাম শাখাওয়াত সাহেবকে, আজ দেখলাম কালাম সাহেবকে মনোনয়ন দিয়েছে। এতে দলের নেতাকর্মী ও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর আমাদের নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। তাই আমরা ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করব। দল যাঁকে ধানের শীষ দেবে, আমরা তাঁর পক্ষেই থাকব।’
এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, মনোনয়ন কয়েকটি ধাপে দেওয়া হয়। কালাম সাহেবসহ নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনে যাদের মনোনয়নপত্র কিনতে দল থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেটি ঠিক আছে। এটিকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কিন্তু প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত মনোনয়ন পরিবর্তন হতে পারে। তাই চূড়ান্ত মনোনয়নের বিষয়টি প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে দলীয় মনোনয়ন যাদের দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে দল থেকে আমাদের এখনও চিঠি দিয়ে কিছু জানানো হয়নি।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, প্রথমে মাসুদুজ্জামানকে মনোনয়ন দেওয়া, এরপর শাখাওয়াত সাহেবের দাবি, এখন আবার আবুল কালাম সাহেবকে মনোনয়ন দেওয়া– এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আমি আশা করি, এটা খুব দ্রুতই নিরসন হবে।
বিএনপির মতো একটি বড় দলে বারবার প্রার্থী পরিবর্তন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহির্প্রকাশ বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভোটারদের মধ্যে বিএনপির প্রতি শ্রদ্ধা কমিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের সম্মান রয়েছে। মাসুদুজ্জামান না হয় নিজে সরে গেছেন। কিন্তু অ্যাডভোকেট শাখাওয়াতকে মনোনয়ন দেওয়া, আবার সেটি সরিয়ে কালাম সাহেবকে দেওয়ায় অ্যাডভোকেট শাখাওয়াতের যে সম্মানহানি হলো, সেটি কে পূরণ করবে? দলের নেতা বলে তাদের সম্মান বিবেচনায় আনা হবে না? কালাম সাহেবকেই যদি মনোনয়ন দেওয়া হবে সেটা আগে দেওয়া হলো না কেন? তিনি আরও বলেন, যেহেতু এখানে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, বিএনপির উচিত দ্রুত তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট বা মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বিষয়টি সমাধান করা।
এ মনোনয়ন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির নেতাকর্মীরা এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বন্দর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবুল কালামের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান মুকুলকে মাসুদুজ্জামান নিজের দিকে নিয়ে এসেছেন। ফলে বন্দর বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক পক্ষ মাসুদুজ্জামানের দিকে, অন্য পক্ষ আবুল কালামের দিকে রয়েছে। দু’পক্ষই বন্দরে বিশাল সমাবেশ করে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে।
শহর বিএনপির বড় অংশ মাসুদুজ্জামানের পক্ষে রয়েছে। তবে ছোট একটি অংশ রয়েছে শিল্পপতি আবু জাফর আহমদ বাবুলের পক্ষে। আবুল কালামের মনোনয়ন শেষ পর্যন্ত থাকলে আবু জাফর আহমেদ বাবুলের নেতাকর্মীরা আবুল কালামের পক্ষে কাজ করবেন।
অন্যদিকে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু মাসুদুজ্জামানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তার নেতাকর্মীরা মাসুদুজ্জামানের পক্ষে রয়েছে।
অ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন খান মাসুদুজ্জামানের বিরোধী গ্রুপে থাকলেও মনোনয়ন পেয়ে আবার বঞ্চিত হওয়ার কারণে তার নেতাকর্মীরা শেষ মুহূর্তে কোন দিকে যায় সেটি এখনও অনিশ্চিত।