Image description

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনামের দেওয়া বিপরীতধর্মী দুটি বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দুটি ভিডিওতেই তার বক্তব্য গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ে। একটি ভিডিওতে তাকে খুব আনন্দিত হয়ে হাসতে দেখা যায়, অন্যটিতে তার কণ্ঠে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং নিরাপত্তাহীনতা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে অতি উচ্ছ্বসিত মাহফুজ আনামের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে মাত্র এক বছরেই। এখন তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন।

বুধবার (২৪শে ডিসেম্বর) ভিডিও দুটি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নেটিজেন ফেসবুকে শেয়ার করে নানা মন্তব্য করেন। ভিডিওগুলো কেন্দ্র করে চলছে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে বলেন, প্রথম ভিডিওতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মাহফুজ আনামের যে 'মোহ' ছিল, তার 'ভঙ্গ' হয়েছে দ্বিতীয় ভিডিওর বক্তব্যে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক, পাঠকনন্দিত কলামিস্ট ও টকশো তারকা মাহবুব কামাল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বুধবার দেওয়া পোস্টে বলেন, 'ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ভাইয়ের ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের  ভিডিওটি দেখে জানলাম, তিনি প্রফেসর ইউনূস সাহেবের মিডিয়া বিষয়ে কথাগুলো বিশ্বাস করেছিলেন। ভিডিওটি দেখা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি কথা মনে পড়েছিল: every  betrayal begins with trust. প্রতিটি বিশ্বাসঘাতকতার শুরুটা বিশ্বাস।'

মাহফুজ আনামের বক্তব্যের দুটি ভিডিওর মধ্যে একটি হচ্ছে ২০২৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বরের। ওইদিন দেশের গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকটি প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম সহাস্যে বলেন, 'আমরা মিডিয়াবান্ধব একটা সরকার প্রধান পেয়েছি। জাতীয় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমকে সোচ্চারভাবে সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।'

এদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি ছাপিয়ে এখন সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তাই যে এখন বড় হয়ে উঠেছে, ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে তা তুলে ধরেন মাহফুজ আনাম ভাইরাল হওয়া দ্বিতীয় ভিডিওর বক্তব্যে।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা ও আগুন দেওয়া এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে গত সোমবার (২২শে ডিসেম্বর) ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্যে সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি সামনে আনেন তিনি। দ্বিতীয় ভিডিওটির বক্তব্য ওই সমাবেশেই দেওয়া।

গত বৃহস্পতিবার রাতে সংগঠিত সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় দেশের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম প্রথম আলো। ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এতে প্রথম আলোর কার্যালয় ভস্মীভূত হয়ে যায়। এরপর ডেইলি স্টারেও হামলা হয়। তাদের কার্যালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করা হয়। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন নূরুল কবীর।

এ হামলার প্রতিবাদে ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক যৌথ প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে দেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ এবং মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (নোয়াব)।

সেদিন ডেইলি স্টার ভবনে আগুন দেওয়ার পর ভেতরে আটকে পড়া সংবাদকর্মীদের প্রাণ সংশয়ে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘এমন যদি হতো যে যারা ডেইলি স্টারকে ঘৃণা করে, তারা বলত—এই সাংবাদিক তোদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই, তোরা বেরিয়ে যা, আমরা বিল্ডিংয়ে আগুন লাগাব। সেই ২৬-২৭ জন (সংবাদকর্মী) ছাদে আটকে ছিল এবং ফায়ার ব্রিগেডকে আসতে দেওয়া হয় নাই।’

এর মধ্য দিয়ে হামলাকারীরা ডেইলি স্টারের কর্মীদের হত্যা করতে চাওয়ার ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন সংবাদপত্রটির সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে (সামাজিক মাধ্যম) একটা দেখা গেছে যে তারা (হামলাকারী) বলছে, ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর যারা সাংবাদিক, তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের হত্যা করতে হবে।’

এই ‘নৃশংস’ ঘটনা সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে মন্তব্য করে জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান মাহফুজ আনাম।

এই প্রতিবাদ সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য দেন। প্রতিবাদ সভা শেষে সোনারগাঁও হোটেলের সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন তারা। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এই কর্মসূচিতে যোগ দেন।