Image description

তিন বছর রাজনীতি না করার শর্তে জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন তৎকালীন ‘রাজনীতির যুবরাজ’ বলে খ্যাত তারেক রহমান। ১৭ বছর পর বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে তিনি পা রাখছেন স্বদেশে। ২০০৮ সালের শেষ দিকে লন্ডন গিয়ে দীর্ঘ সময় নির্বাসিত জীবন শেষে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে রাঙিয়ে তোলার সব আয়োজন করেছে বিএনপি। রাজধানীর উপকণ্ঠে তিনশ’ ফিট সড়কে নির্মিত বিশাল মঞ্চে তারেক রহমান গ্রহণ করবেন নেতাকর্মী ও অনুসারীদের সংবর্ধনাও।

তারেক রহমানের এই ফিরে আসার মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীরা যেমন উজ্জীবিত, তেমনই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক ও পুরোপুরি নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে। তারেক রহমানের এই উপস্থিতি দল ও দেশের মানুষের জন্য স্বস্তির।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস চরম এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। এ অবস্থায় এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির নেতা হিসেবে তারেক রহমানের দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের সূচনা হবে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে বিএনপি। সঠিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সন্দেহ, দেশে চরমপন্থি সংগঠনগুলোর নানামাত্রিক উত্থানসহ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান।

তারেক রহমান (ফাইল ফটো)

তারেক রহমান (ফাইল ফটো)

‘তারেক রহমান দেশে আসছেন এতদিন পর এটা মোটেও স্বস্তির বা আনন্দের ফেরা—এভাবে বলা যাবে না। কারণ খুবই অনিশ্চয়তার একটা প্রেক্ষাপটে উনি এই দেশে আসছেন’— রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি হিসাব করে দেখলাম,  বাংলাদেশে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত যে সময়টা, দেশের টার্মওয়েলের যদি হিসাব করি, ওর পর এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি টার্মইলেটে যাচ্ছে। মানে নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার দল জিতবে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটা আমি কনফিডেন্ট একেবারেই। কেউ কেউ জামায়াত নিয়ে যতটুকু বলে, আমি এটা মোটেও—আই ডোন্ট বাই দিস আরগুমেন্ট। কিন্তু ওই নির্বাচন পর্যন্ত যাওয়ার যে ব্যাপারটা, নির্বাচন হবে আমি তাও মনে করি, কিন্তু চ্যালেঞ্জ আছে প্রচুর।’

কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন তারেক?

ডা. জাহেদ উর রহমান ব্যাখ্যা করেন, ‘নানান রকম নন-স্টেট অ্যাক্টরস আছে, অ্যানারকিস্ট আছে। তারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য নানা রকম চেষ্টা করে যাবে। ফলে তিনি নামার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে প্রধান যে চ্যালেঞ্জ হবে সেটা হচ্ছে, এই যে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যা বলছি— সরকারের মধ্যে লোকজন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে শুরু করে, পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন জায়গায় আছে, এর বাইরেও কিছু লোকজন অ্যানারকিস্ট হিসেবে আছে। তারা যাতে তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হতে না পারে, সেই দায়িত্ব পালন করা।’

তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় বলি যে বিএনপি ক্রমাগত ফাইট করে গেছে বলেই শেখ হাসিনা স্বস্তিতে ছিলেন না। বিএনপি ভেঙে পড়লে কিন্তু সেটা হতো না। ওই সময় যে লড়াই, এখন আবার দেশের এই নির্বাচন পর্যন্ত দেশটাকে নিয়ে যাওয়া—এখানে নিজের দলকে ইন্টিগ্রেটেড রাখা, নির্বাচনের সময় যাতে হাঙ্গামা না হয়, দলের লোকজন যাতে নিজেদের মধ্যে বা অন্য দলের সঙ্গে হাঙ্গামায় না জড়ায়, এদিকটিও খেয়াল রাখা।’

‘কারণ আমাদের যেহেতু নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থা ভালো না, এসব নিয়ন্ত্রণ করে রেখে নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, নির্বাচন শেষ করা—এখানেই তার সামনে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি আছেন।’

প্রস্তুত সংবর্ধনা মঞ্চ, দেশে ফিরে এখানেই বক্তব্য রাখবেন তারেক রহমান, ছবি: নাসিরুল ইসলাম

প্রস্তুত সংবর্ধনা মঞ্চ, দেশে ফিরে এখানেই বক্তব্য রাখবেন তারেক রহমান, ছবি: নাসিরুল ইসলাম

ডা. জাহেদ বলেন, ‘এখন একটা ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি যথেষ্ট কানেক্টেড ছিলেন, এই ডিজিটাল যুগে কানেক্টেড থাকা সোজা না। কিন্তু তারপরও এটা সরাসরি মাঠে থাকার চাইতে একেবারে বিকল্প হয়ে যায় না। ফলে তিনি নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন যে এই সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন মাঠে আসাজনিত কারণ সুবিধাও দেবে। এটা সুবিধাও দেবে এরকম যে তিনি যেহেতু অনেক কিছু দূর থেকে দেখেছেন, কাছ থেকে দেখে ভালো করতে পারবেন। আবার একইসঙ্গে উনি যেহেতু রিচাবল হচ্ছেন, সেটা কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা তৈরি করার সম্ভাবনা থাকবে। অনেকে চাইলে এখন রিচ করতে পারবে। তো এই চ্যালেঞ্জগুলো তার সামনে আছে। কিন্তু তাকে সেটা উতরাতে হবে।’

নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষের কাছে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে জাহেদ উর রহমানের ভাষ্য, ‘এটা খুবই বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কারণ তার নিরাপত্তা যেভাবে নিশ্চিত রাখতে হবে, তিনি আসলে খুব কমফোর্টেবলে এই কাজটা করতে পারবেন না। এটা আসলে মেনেই হয়তো নিতে হবে। এত লিস্ট ফর দ্যা টাইমিং। তো এটা মনে রাখার ব্যাপার আছে। এই পরিস্থিতি হবেই, এটা হচ্ছে নির্বাচনের আগে।’

‘নির্বাচনের পরের সমস্যা যেটা এটা সম্ভবত আরও বড় হতে যাচ্ছে। কারণ মনে রাখতে হবে— একটা স্টেটের স্ট্র্যাকচার পুরো ভেঙে ফেলছেন শেখ হাসিনা। শুধু শেখ হাসিনা না, যেকোনও স্বৈরাচারী শাসকই সব ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া তার ইয়ে হবে না। তো যেটা দাঁড়াবে এই ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করা। যদিও আমি মনে করি, নির্বাচন হলে সব কিছু অনেক স্মুথ সফটার হয়ে যাবে ভালো হবে। কারণ নির্বাচিত সরকার থাকলে এটা হবে। তারপরও এগুলোকে নিয়ে কাজ করা চ্যালেঞ্জ।’

বুধবার মঞ্চ ঘিরে নেতাকর্মীদের ভিড়, ছবি: নাসিরুল ইসলাম

বুধবার মঞ্চ ঘিরে নেতাকর্মীদের ভিড়, ছবি: নাসিরুল ইসলাম 

‘দ্বিতীয়ত যেটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আরও হবে মনে হয়, মানুষের এক্সপেকটেশন, মানে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যে এক্সপেকটেশন ছিল—একটা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সেই এক্সপেকটেশন আরও বাড়বে। এই জিনিসগুলো মিট করা তার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। তার উচিত হবে মানুষকে এটা আসলে বলে রাখা যে খুব রাতারাতি কিছু হবে না। কিন্তু তারপরও মানুষ ওগুলো চাইবে।’

জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘অনেক চ্যালেঞ্জ আপনারা-আমরা সবাই জানি। জননিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, অর্থনীতি ভালো করা, বেকারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এটা খুব জরুরি। মানে প্রায়ই কথাটা বলছি—নেপাল একটা লার্নিং হওয়া উচিত যে নেপালে বৈধ সরকারকে ফেলে দিয়েছে তরুণরা, কারণ তাদের চাওয়া পূরণ হচ্ছিল না।’

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ন্ত্রণ করা হবে তারেক রহমানের সামনে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যেহেতু গণভোট প্রশ্নে এখনও বিএনপি স্পষ্ট না, সেক্ষেত্রে আগামী সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে হবে বিএনপিকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দলকে দেওয়া আসন, দলের একক প্রার্থী নিশ্চিত করাসহ এই চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে পড়বেন তারেক রহমান।’

 বিদেশে থাকলেও বিগত বছরগুলোতে দলের নেতাদের নিয়মিত দিকনির্দেশনা দেন তিনি

বিদেশে থাকলেও বিগত বছরগুলোতে দলের নেতাদের নিয়মিত দিকনির্দেশনা দেন তিনি 

জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত?

২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার আগের দিন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। এরপর থেকে স্থায়ী কমিটি নিয়মিত একটি এজেন্ডাভিত্তিক বৈঠক শুরু করে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অনুমতি দেন। নির্বাচিত সদস্যরা তারই নির্দেশে পার্লামেন্টে যান। একমাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পার্লামেন্টে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর ঐক্যফ্রন্ট ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। দূরত্ব বাড়তে থাকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে। তৃণমূল নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেন। ধীরে ধীরে ২০ দলীয় জোট ক্রমান্বয়ে নিষ্ক্রিয় করেন তারেক রহমান। এরপর ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন।

করোনাভাইরাসের পর ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা শুরু করে বিএনপি। একটি স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থাসহ শাসনতান্ত্রিক নানা পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক ও বামধারার দলগুলো ঐকমত্য পোষণ করে।

তারেক রহমান ২০১৬ সালে বেগম জিয়ার নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাব, ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’-কে সামনে রেখে ২০২২ সালে ঘোষণা করেন পরিবর্তনের ২৭ দফা। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ৩১ দফা নির্ধারণ হয়। যুগপৎ সঙ্গীদের প্রত্যেকটি দল ৩১ দফা ঘোষণা করে। বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশানে ৩১ দফা ঘোষণা করেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ভাষ্য—বিএনপি দেশের মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা থেকে শুরু করে বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, সব আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির উত্তরাধিকার অনেক প্রাসঙ্গিক। বিগত আন্দোলনেও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি দেশের প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় থেকেছে। এটি তার নেতৃত্বের সুযোগ্য উদাহরণ।

ইকবাল হাসান মাহমুদ বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে স্বৈরাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এরপর আবার দেশের মানুষের বুকে শেখ হাসিনাও স্বৈরাচারী শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। গত ১৬ বছর কত মানুষের ক্ষতি করেছে, নিপীড়িত হয়েছে। আমিও দেশের বাইরে ছিলাম, আড়াই বছর ছিলাম বাইরে। এখন তারেক রহমানও ফিরছেন। তার এই আসা নিয়ে উদ্দীপনা আজকে থেকে স্পষ্ট। মানুষ তার দিকে তাকিয়ে ছিল প্রমাণ করে। দুই নম্বর বিষয় হচ্ছে—দেশে শাসনের ভ্যাকুইম সৃষ্টি হয়েছে, উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে। তার ফেরার মধ্য দিয়ে মধ্যবর্তী রাজনীতির উত্থান ঘটবে, দেশের মানুষ এগিয়ে যাবে।’

লন্ডনে মায়ের সঙ্গে তারেক রহমান

লন্ডনে মায়ের সঙ্গে তারেক রহমান নেতাদের কারও কারও মন্তব্য, ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নেওয়ার পর থেকে প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালের আগে রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে বিএনপিকে ডানপন্থি ঘরানার রাজনৈতিক দল থেকে বের করে নিয়ে এসে মধ্যম ডানপন্থি এবং বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কাজ করার যে সূত্রপাত হয়, তার মূল ভূমিকায় ছিলেন তারেক রহমান। তাকে সহযোগিতা করেছেন স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য। অতি সম্প্রতি তারেক রহমান জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন তারেক। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের পাতানো নির্বাচনের প্রাক্কালে, তিনি গৃহবন্দিত্ব এড়িয়ে এবং প্রেস ক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্সে কীভাবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল তা বর্ণনা করেন।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তারেক তার মায়ের সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সালে দলের গাবতলী উপজেলা ইউনিটে সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি তার মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেন। তার মা বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

লন্ডনে মায়ের সঙ্গে তারেক রহমান

লন্ডনে মায়ের সঙ্গে তারেক রহমান

শায়রুল কবির খান উল্লেখ করেন, বগুড়ায় তৃণমূল থেকে নেতা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন তারেক রহমান, যেখানে বিএনপি শাখার একজন নির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে বগুড়া জেলা ইউনিটে তিনি একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন, যেখানে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। 

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা এবং সুশাসনের ওপর গবেষণা করার জন্য ঢাকায় একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। তার প্রচেষ্টায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। চেয়ারপারসনের ছেলে হয়েও এবং তৃণমূল থেকে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বজনপ্রীতি করে কোনও মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্যপদ গ্রহণ না করে দলের তৃণমূলের ক্ষমতায়নে মনোনিবেশ করেন।

যদিও ওই সময় দেশে, বিদেশে তারেক রহমানের প্রতিষ্ঠিত ‘হাওয়া ভবন’ বিকল্প সরকার গড়ে তুলেছিল বলে সমালোচনা করে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও নানা সমালোচনা উল্লেখ করে প্রতিবেদন করা হয়।

২০০২ সালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে মনোনীত হন তারেক রহমান। ২০০৫ সালে তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল সম্মেলন আয়োজন করেন। ২০০৭ সালে সামরিক শাসকদের সমর্থিত সরকার গ্রেফতার করে তাকে। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের শেষ দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হয়েছিল। লন্ডনে থাকা অবস্থায় তিনি ২০০৯ সালে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তাকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার পর তৃতীয় নেতা তারেক রহমান

১৯৭১ সালে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, ভারত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার নেতার স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সেই ঘটনা ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু।

রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছেন। চূড়ান্ত বিজয়ের পর ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর জন্য অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানান। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে  ভাষণ দেন তিনি।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী

খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে প্রাণে বেঁচে যান তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালে ১৯৮১ সালে ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের এই দিনে স্বদেশে ফিরে আসেন তিনি। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ওই দিন সারা দেশ থেকে আসা লাখো মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার পর বড় কোনও রাজনৈতিক নেতা তারেক রহমান, যিনি এত দীর্ঘ সময় নির্বাসিত জীবন শেষে ফিরছেন স্বদেশে। ২০০৮ সালে তৎকালীন শাসকদের শর্তে ছেড়েছিলেন দেশ। বিচারপতি হাবিবুর রহমান রচিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জিতে ১৯৭১-২০০১ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছন, ‘তিন বছর রাজনীতি না করার শর্তে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান তারেক রহমান।’

তবে রাজনৈতিকভাবে তারেক রহমান একমাত্র কোনও নেতা, যার সঙ্গে প্রবাসে বাংলাদেশের কোনও সরকার-প্রধান সাক্ষাৎ করেছেন।

বিএনপির সূত্রগুলো জানাচ্ছে, চলতি বছরের জুনে লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন

নেতারা জানাচ্ছেন, তারেক রহমানের ফেরার দিনটিকে স্মরণীয় করতে সর্বোচ্চ জমায়েতের টার্গেট রয়েছে বিএনপির। তারা মনে করছেন, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জমায়েতটি তারা করতে সক্ষম হবেন।

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফও দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক নেতা নিবাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে সরাসরি ক্ষমতায় গিয়েছেন।

ওয়ান-ইলেভেনের সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলে সেবা করেন মা খালেদা জিয়া

ওয়ান-ইলেভেনের সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছেলে সেবা করেন মা খালেদা জিয়া

অভ্যর্থনা সঞ্চালনা করবেন মির্জা ফখরুল, বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান

দেশে ফেরার পর রাজধানীর উপকণ্ঠে তিনশ’ ফিটে স্থাপিত অভ্যর্থনা মঞ্চে বক্তব্য দেবেন তারেক রহমান। দায়িত্বশীলরা জানান, বিমানবন্দরে তারেক রহমানকে রিসিভ করবেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এরপর তারেক রহমান বিশেষ নিরাপত্তায় রওনা করবেন অভ্যর্থনা মঞ্চের উদ্দেশে। সঙ্গে থাকবেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

সূত্র জানিয়েছে, মঞ্চে বক্তব্য দেবেন কেবল তারেক রহমান। মির্জা ফখরুল সঞ্চালনা করবেন। তিনি অনুষ্ঠানে দেশে ফেরার পর আবেগ প্রকাশ ও দেশবাসীর সামনে শুকরিয়া জানাবেন। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেবেন নির্দেশনামূলক বক্তব্য।

তারেক রহমানের অভ্যর্থনা বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক সালাহ উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, তারেক রহমান বৃহস্পতিবার ঢাকায় ল্যান্ড করে অভ্যর্থনাস্থলে যাবেন। সেখান থেকে তিনি এভারকেয়ারে যাবেন। অসুস্থ মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাসায় ফিরবেন। পরদিন তিনি জুমার নামাজের পর জিয়াউর রহমানের মাজার ও স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

উল্লেখ্য, তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডন থেকে স্বদেশে ১৭ বছর পর ফিরছেন তার কন্যা জাইমা জারনাজ রহমান। সঙ্গে থাকবেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানসহ ব্যক্তিগত সহকারীরাও।