Image description
বিএনপির আসন সমঝোতা আগামী সপ্তাহে

বিএনপির সঙ্গে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত হচ্ছে আগামী সপ্তাহে। তবে সমঝোতার আসল ম্যাজিক হলো মিত্র দলের তারকাখ্যাত প্রার্থীরা ভোট করবেন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে। কিন্তু কিভাবে! নির্বাচন কমিশনের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী এবার তো সে সুযোগ নেই। নিবন্ধিত দলের প্রার্থীরা বিএনপির সঙ্গে জোট করলেও নির্বাচন করতে হবে নিজ দলের প্রতীকে। এজন্য সমঝোতায় থাকছে নতুন চমক। জোটের সেই সব ভাগ্যবান প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নিজ দল ছেড়ে যুক্ত হবেন বিএনপিতে। এরপর যথারীতি ধানের শীষ নিয়েই নামবেন ভোটের মাঠে। ইতোমধ্যে এমন আলোচনা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। তাই আসন নিয়ে শরিকদের সঙ্গে বিএনপির মধ্যে মনোমালিন্যের যে কালোছায়া স্পষ্ট হচ্ছিল, তা এখন আনন্দধারায় রূপ নিতে যাচ্ছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, এ তালিকায় মিত্র দলগুলোর অন্তত দশ শীর্ষ নেতা রয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তারা নিজ দল থেকে শিগগির পদত্যাগ করে বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করবেন। তবে মিত্র শরিকদের মধ্যে যারা অনিবন্ধিত দল, তাদের প্রার্থীদের দল থেকে পদত্যাগ করতে হচ্ছে না। এ নিয়ে গত বুধবার থেকে মিত্র দল ও জোটের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। যা ফলপ্রসূ হয়েছে। বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

আসন নিয়ে সৃষ্ট মতবিরোধ নিষ্পত্তি করতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। বুধবার প্রথম দিনের বৈঠকে ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটকে একটি করে আসনে ছাড়ের ইঙ্গিত দিয়েছে দলটি। এছাড়া ১২ দলীয় জোটকে আরেকটি আসন ছাড় দেওয়া নিয়েও আলোচনা অব্যাহত আছে। এই দুই জোটের অন্য দলগুলোকে ভিন্নভাবে মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়েছে বিএনপি। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, পিরোজপুর-১ আসনে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার ও নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদকে আসন দেওয়ার ব্যাপারে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ৫ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ ও গণফোরামের সঙ্গে বৃহস্পতিবার আসন ভাগাভাগি নিয়ে বৈঠকে করে বিএনপি। আজ শুক্রবার বৈঠক করার কথা রয়েছে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) এবং বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির সঙ্গে। সব দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিএনপি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দুই নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে, এমন বিধানের ফলে ভোটের হিসাব-নিকাশ করে ভেবেচিন্তে আসন ছাড় দিতে চায় বিএনপি। কারণ, এমন বিধানে ভোট করে অন্য কোনো দল বা তাদের প্রার্থী জিতে আসতে পারবে কিনা তাও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে জয় নিশ্চিত করার জন্য বিএনপির ধানের শীষ প্রতীককে নির্বাচন করতে ভরসা হিসাবে দেখেন ছোট দলের বড় নেতারা। কারণ বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলের প্রতীকে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। মূলত এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মিত্র দলের শীর্ষ নেতারা ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করতে চান। বিএনপিও সার্বিক বিষয় মূল্যায়ন করে তাদের হাতে ধানের শীষ তুলে দিতে চায়। এজন্য যে কৌশল নেওয়া দরকার শেষ পর্যন্ত সেটিই করা হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘বিগত যুগপৎ আন্দোলনে আমাদের যে কনসেপ্ট ছিল, ওইভাবে আমাদের কিছু আসন শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দুই ধাপে ২৭২ আসনে সম্ভাব্য একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তবে এখনো ২৮টি আসন ফাঁকা রাখা আছে। ইসির তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের জন্য বেশ কয়েকটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। আবার মিত্র দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার আসনে বিএনপি প্রার্থীও দিয়েছে। আসন সমঝোতা হলে দু-একটি আসন থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করা হবে। ফাঁকা রাখা আসনগুলোতে শরিক দলের শীর্ষ নেতারা হলেন-পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা-১৭ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, ঢাকা-১৩ আসনে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক, কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানের আসন। এসব আসনে তাদেরই মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত একরকম নিশ্চিত।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাবনা-১ (সাঁথিয়া) আসনটি গণফোরাম নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। এবারও তিনি আলোচনায় এগিয়ে আছেন। এছাড়া ঢাকা-১২ আসনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক এবং নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নির্বাচন করতে চান। তবে এই দুই আসনে বিএনপি সম্ভাব্য প্রার্থী দিয়েছে।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে বেশির ভাগ নেতা (নিবন্ধিত দল) নিজ দল থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগদান করে ধানের শীষে ভোট করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। আর যাদের নিবন্ধন নেই তারা তো আগে থেকেই বিএনপির প্রতীকে ভোট করতে সম্মত আছেন। এর মধ্যে মোস্তফা জামাল হায়দার ও ফরিদুজ্জামান ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তারা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন।

ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা প্রসঙ্গে ববি হাজ্জাজ যুগান্তরকে বলেন, নানা ধরনের বাস্তবতায় রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে অনেক কিছু করতে হতে পারে। সেটা যদি করতেও হয় তা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে করা হবে।

তবে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, দল থেকে পদত্যাগ করে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে রাজি নন মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক, আন্দালিব রহমান পার্থ, জোনায়েদ সাকি ও নুরুল হক নুরসহ আরও কয়েকজন। তারা নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বিএনপির আলোচনা চলছে। আর এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক এবং দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদও নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবেন। এ দুটি আসনে বিএনপি ছাড় দেবে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার আসন ঢাকা-৮ এর বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কথা হয়েছে। যেহেতু এই আসনে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাস, তাই পরিবর্তন করতে পারছে না। কিন্তু ঢাকা-১২ আসন বিএনপি অফার করলে আমরা পজেটিভলি সিদ্ধান্ত নেব।’

এর আগে একমাত্র লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপির সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমের প্রার্থিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি সম্প্রতি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনায় তাকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী করার লক্ষ্যে যোগদান করানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বাইরে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে বিএনপির কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। দলটিকে চারটি আসন ছাড়তে চায় বিএনপি। এজন্য সম্ভাব্য আসনগুলোতে প্রার্থী ঘোষণা করেনি দলটি। জমিয়ত আরও ছয়টি আসন চায়। যদিও সেগুলোতে ইতোমধ্যে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঢাকা-১০ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন-এটি অনেকটাই নিশ্চিত। তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন, ইতোমধ্যে এমন আলোচনাও ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ওই সংসদীয় আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর বাইরে তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রয়েছে বিএনপির। সূত্র জানায়, পর্দার আড়ালে দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় আসন সমঝোতা হবে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।