Image description
গরিবের পাতে উঠছে না তেলাপিয়া-পাঙাশও

সামর্থ্য না থাকায় খাবার তালিকা থেকে অনেক আগেই বাদ পড়েছে মাংস। এর মধ্যেই মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যে রীতিমতো অস্থির মাছের বাজার। এদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে খুচরা বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট। এই দুই চক্র মিলে বাড়াচ্ছে দাম। এতে চাষি লাভবান না হলেও বাড়তি মূল্যে সব ধরনের মাছ কিনতে হচ্ছে ক্রেতাকে।

অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, চাষির ১৫০ টাকা কেজির পাঙাশ ক্রেতা কিনছেন ২১০ টাকায়। তেলাপিয়ায় কেজিতে গুনতে হচ্ছে ২৬০ টাকা। লাগামহীন দাম-উধাও হয়ে যাচ্ছে গরিবের আমিষ জাতীয় খাবার তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছ। উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মাছ কিনতে পারছেন না। বাজারে অন্যান্য মাছের কেজিও ৪০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এতে ধরেছে টান আমিষে। কেনার সময় অনেকে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বৃহস্পতিবার খুচরা বাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, যে পণ্যের দাম যা হওয়া উচিত সরকারের উচিত সেগুলো মনিটর করা। যাতে অসাধুরা কারসাজি করতে না পারে। এতে গরিবেরও উপকার হবে।

সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ এলাকার উদ্যোক্তা ও মাছচাষি রাশিদুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, প্রতি কেজি পাঙাশ ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি করছেন ১৫০ টাকা কেজি। আড়তদাররা পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন ১৮০ টাকা। আর পাইকাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। আর খুচরা বিক্রেতারা ক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন ২১০ টাকা কেজি দরে। তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় ১ টনের কাভার্ডভ্যানে মাছ আনতে ১১ হাজার টাকা খরচ হয়।

এছাড়া ৩৩ শতকের এক বিঘা পুকুর লিজ নিতে বছরে খরচ ৪০-৪৫ হাজার টাকা। পাশাপাশি মাছের খাবারের দাম প্রতি টন ৬০-৬৫ হাজার টাকা। সব মিলে পাঙাশ চাষে কেজিপ্রতি খরচ হয় ১৪০ টাকা। বিক্রি করতে হয় ১৫০ টাকা কেজি। তিনি বলেন, পুকুরের জমির লিজের দাম, শ্রমিকের মজুরি এবং মাছের খাবারের দাম অনেক বেশি। এরপরও চাষি পর্যায়ে মাছের দাম বেড়েছে খুব কম। এর চেয়ে প্রায় তিনগুণ দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এটা করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রতি কেজি পাঙাশ বিক্রি হয় ১৯০-২০০ টাকায়। একই মাছ রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজার, নয়াবাজার ও জিনজিরা কাঁচাবাজারে কেজিপ্রতি ২০০-২১০ টাকায় বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে। গত বছর এই সময় কেজি ছিল ১৬০-১৭০ টাকা। হিসাব করে দেখা যায়, একটি মাঝারি সাইজের পাঙাশ ওজন দিলে দেড় কেজি হয়। সে ক্ষেত্রে একটি পাঙাশ কিনতে ক্রেতার খরচ হয় ৩০০-৩২০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা। প্রতি কেজি মাঝারি আকারের চাষের রুই বিক্রি হচ্ছে ৩৩০-৩৫০ টাকায়, কই প্রতি কেজি ২৫০-৩০০ টাকা, চাষের শিং ৪৫০ টাকা, পাবদা ৩০০-৩৫০ টাকা, বড় চিংড়ি প্রতি কেজি ৮০০-৯০০ টাকা, শোলের কেজি ৮০০ টাকা, টেংরা ৫০০-৬০০ টাকা এবং মলা প্রতি কেজি ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর নয়াবাজারে মাছ কিনতে এসেছেন লাইজু আক্তার। বাজারে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরছেন। যে দোকানেই যাচ্ছেন বিক্রেতাদের কাছে দাম জানতে চাইছেন। কিন্তু মাছ কিনছেন না। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা, তাই কেনা বাদ দিয়েছি। কারণ আমার সামর্থ্যে কুলাচ্ছে না।

ফার্মের মুরগির মাংসের দামও চড়া। আগে কম দামে পাঙ্গাশ মাছ কিনতাম, তার দামও বেড়ে গেছে। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি মন খারাপ করে সামান্য কিছু তরকারি কিনে চলে যান। ওই বাজারের খুচরা মাছ বিক্রেতা মো. সাগর বলেন, কয়েক মাস ধরে চাষি পর্যায়ে মাছের দাম অনেক বাড়তি। যে কারণে আড়তে দাম বেড়েছে। আর আমরা খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে এনে বেশি দামে বিক্রি করছি। আমাদের কোনো দোষ নেই।

বাংলাদেশ ফিশ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, মাছের খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ, বিদ্যুৎ বিল ও মজুরি বাড়ার কারণে মূলত মাছের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। মাছের খাদ্যের মান ভালো না হওয়ার কারণেও উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তবে চাষি পর্যায়ে যে হারে দাম বেড়েছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা তার চেয়ে উচ্চদামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করছেন। মাছ চাষ করে একজন চাষি কেজিতে ১০ টাকার বেশি লাভ করতে পারছেন না। অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা একদিনের ব্যবধানেই কেজিতে ৪০-৫০ টাকা লাভ করছেন।

যশোরের ঝিকরগাছার মাছ চাষি মো. আলমগীর কবির যুগান্তরকে বলেন, বিঘাপ্রতি পুকুর লিজ নিতে ২০ হাজার টাকা বেড়েছে। শ্রমিকের মজুরি দিনে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এছাড়া মাছের খাবারের দাম প্রতি টনে ৩০ হাজার টাকা বেড়েছে। খরচ বাড়লেও চাষি পর্যায়ে যে দামে মাছ বিক্রি হচ্ছে, খুচরায় তার তিনগুণ বেশিতে বিক্রি হচ্ছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে নিু ও মধ্যবিত্তের হিমশিম খেতে হচ্ছে। যাদের আলুভর্তা ও ডিম-ডাল দিয়ে কোনোভাবে দুই বেলা চলত, তারাও এখন প্রায় নিরুপায়। মানুষের জীবনযাত্রায় খরচ বেড়েই চলেছে। কিন্তু আয় বাড়ছে না। ভোক্তার সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বাজারে ডিম, মুরগি ও তেলাপিয়া-পাঙ্গাশ- এ তিন উৎস থেকে কিছুটা কম দামে প্রোটিন পাওয়া যেত। স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের আমিষের চাহিদা পূরণ করতেন। উচ্চমূল্যের কারণে সেটুকুও পারছেন না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সব ধরনের পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে তারা কাজ করছে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। তারপরও বাজারে অভিযান পরিচালনা করে যৌক্তিক দামে পণ্য বিক্রি করার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মাছের বাজারেও অভিযান পরিচালনা করা হবে।