Image description

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও মিত্র দলগুলোর মধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার সময় অতি সন্নিকটে হলেও প্রধান শরিক দল বিএনপির তাদের সঙ্গে আসন বণ্টনসহ নির্বাচনী কৌশল বা বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে কোনো ফলপ্রসূ আলোচনাও শুরু হয়নি। এই নিয়ে দলগুলোর নেতাদের মধ্যে

ক্ষোভ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা মনে করেন, বিএনপির এ ধরনের আচরণ অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। শরিকদের অভিযোগ, বিএনপি একতরফাভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে আসন বণ্টন বা কৌশল নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি, যা বিএনপির জন্য আত্মঘাতী।

শরিকদের ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেই যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে ‘আসন সমঝোতা’ নিয়ে এক ধরনের আলোচনা শুরু করেছে বিএনপি। গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে দলটির নেতাদের বৈঠক হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আলোচনায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে বের হয়ে যান। বৈঠকে সাইফুল হকসহ দলটির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য আকবর খান উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির পক্ষে ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন নেতা। তারা দীর্ঘ সময় জোটের মনোনয়নের ব্যাপারে আলোচনা করেন।

মঙ্গলবারের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল—সাইফুল হক যে আসনে নির্বাচন করতে চাইছেন, সেখানে বিএনপি তাকে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে কিছুটা অপারগতার ইঙ্গিত দিচ্ছে, এজন্য বিএনপির হাইকমান্ড বিব্রত। এ পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় গেলে সাইফুল হককে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সে বিষয়ে কথা বলেন। তবে সাইফুল হক বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি, তিনি আলোচনা অসমাপ্ত রেখে বের হয়ে যান।

সাইফুল হক ঢাকা-৮ আসনে (মতিঝিল-পল্টন-শাহজাহানপুর-শাহবাগ ও রমনা) নির্বাচন করতে আগ্রহী। সেখানে সম্ভব না হলে তিনি ঢাকা-১২ আসনে (তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল-হাতিরঝিল-শেরেবাংলা নগর আংশিক) নির্বাচন করতে চান। সাইফুল হক এই এলাকার বাসিন্দা ও ভোটার। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে তার সাংগঠনিক কার্যক্রম রয়েছে। যদিও দুটি আসনেই বিএনপি গত ৩ নভেম্বর প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তারা হলেন ঢাকা-৮ আসনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং ঢাকা-১২ আসনে ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নীরব।

 

এদিকে আস্থা-অনাস্থার সম্পর্কের মধ্যেই গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর শিশুকল্যাণ ভবনে নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়ে এক জরুরি সভা ডাকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ২৯টি দলের শীর্ষ প্রতিনিধিরা। সভার মূল বিষয়বস্তু ছিল বিএনপির বর্তমান আচরণ এবং আসন্ন নির্বাচনে শরিকদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করার বিষয়ে। দলগুলো দু-একদিনের মধ্যেই বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, গণফোরাম ও নেজামী ইসলামী পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন নেতা কালবেলাকে বলেন, যুগপতের একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছেন। বহু প্রতিকূলতা ও নির্যাতন এবং হামলা-মামলা সহ্য করেছেন। কিন্তু নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এসে যখন আসন বণ্টন ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন আসছে, তখন তাদের আলোচনার বাইরে রাখা হচ্ছে।

একজন শরিক দলের নেতা বলেন, ‘আমরা শুধু আন্দোলন নয়, এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হতে চাই। কিন্তু বিএনপি যদি আমাদের ন্যূনতম মর্যাদাটুকু না দেয়, তাহলে এই জোটের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।’

শরিক দলগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তাদের ভূমিকা এবং ত্যাগ স্বীকারের ভিত্তিতে আসন্ন নির্বাচনে তারা বিএনপির কাছে ন্যায্য সংখ্যক আসন চান। তারা মনে করেন, শুধু কিছু ‘ডামি’ আসন দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হলে তা এই বৃহত্তর ঐক্যের জন্য সুখকর হবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুগপতের শরিক ২৯টি দলের শীর্ষ নেতাদের সভায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হলেও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো কোনো চরম পদক্ষেপ নিতে চাইছে না দলগুলো। বরং তারা এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই নিজেদের দাবিগুলো জোরালোভাবে উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ধরে রাখা জরুরি। তাই আপাতত ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে আনার কৌশল নিতে চাইছেন তারা।

যুগপতের শরিক দলগুলোর নেতাদের মতে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে তাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, এই জোট একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। তাই বিএনপির উচিত হবে এই জোটের শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমন্বিত নির্বাচনী পরিকল্পনা তৈরি করা। নতুবা, এককভাবে কোনো বড় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তার ফল হিতে বিপরীত হতে পারে।

এদিকে বিএনপি ২৭৩টি আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলেও ২৭টি আসন এখনো ফাঁকা রেখেছে। রাজনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে যুগপতের শরিক দলগুলোর জন্য এই ২৭টি আসন সংরক্ষিত রাখা হতে পারে। এই ২৭টি আসন ঘিরে শরিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের জল্পনা ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।

তবে শরিক নেতারা বলছেন, ফাঁকা আসনগুলো তাদের প্রাপ্য মর্যাদার চেয়ে কম হতে পারে। তাদের দাবি, তারা আরও বেশি সংখ্যক আসনে নির্বাচন করতে সক্ষম এবং তাদের জনসমর্থন রয়েছে। তাদের আশঙ্কা—যদি আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ আসন নিশ্চিত না হয়, তাহলে এই ফাঁকা আসনগুলো পরবর্তী সময়ে দায়সারাভাবে বণ্টন করা হতে পারে। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে তারা দ্রুত বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন।

শরিকরা আশা করছেন, বিএনপি এই সংবেদনশীলতা উপলব্ধি করে দ্রুত তাদের সঙ্গে বসবে এবং একটি সম্মানজনক সমাধান বের করবে। কারণ, একটি শক্তিশালী বিরোধী ঐক্যই আসন্ন নির্বাচনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বিলুপ্ত ২০ দলীয় জোটের শরিক এবং বিগত যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে ছিলেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা সংবাদ সম্মেলন ডাকলেও পরে বিএনপির অনুরোধে তা স্থগিত করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ-৫ (নিকলী-বাজিতপুর) আসনে নির্বাচন করতে চান।

গতকালের বৈঠক প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি ছাড়া যুগপতের শরিকরা বৈঠক করেছে, যেখানে ২৯টি দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। আমরা বিএনপির সাম্প্রতিক কার্যক্রম ও আচরণ নিয়ে আলোচনা করেছি। দলগুলোর শীর্ষ নেতারা মনে করছেন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি একলা চলো নীতিতে এগোচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপি বন্ধু ছেঁটে ফেলার কৌশল নিয়েছে, যা দলটির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দু-একদিনের মধ্যেই বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কথা বলব।’