গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেয়া হচ্ছে। মেডিকেল বোর্ড তাকে লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে। কাতারের আমীরের দেয়া রাজকীয় এয়ার এম্বুলেন্সে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হবে। তার সঙ্গে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ ১৭ জন। রাতেই কাতারের আমীরের দেয়া রাজকীয় এয়ার এম্বুলেন্স ঢাকায় পৌঁছার কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে এটি পৌঁছাতে বিলম্ব হবে বলে জানানো হয়। ওদিকে শাশুড়িকে নিতে লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান সকাল ৮টার দিকে বাংলাদেশে পৌঁছাবেন। তিনি দেশে আসার পরপরই খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার এম্বুলেন্সে লন্ডন যাত্রার প্রস্তুতি রয়েছে।
চিকিৎসক ও দলের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার থেকে এম্বুলেন্সযোগে হয়রত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেয়া হবে। তাকে ভর্তি করা হবে অত্যাধুনিক লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালে।
এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়া টানা ১২ দিন ধরে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড তার চিকিৎসা পরিচালনা করছে। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। খালেদা জিয়ার ফুসফুসে সংক্রমণের যে জটিলতা রয়েছে, ফুসফুসের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে তাকে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। তাতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে হৃদযন্ত্রসহ কয়েকটি জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত। বৃহস্পতিবার লন্ডন ও চীন থেকে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে খালেদা জিয়াকে সরাসরি দেখেছেন এবং সর্বশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছেন। তাদের সঙ্গে তিন দফা ভার্চ্যুয়ালি বৈঠকও হয়েছে।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য জানিয়েছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। সবচেয়ে ভালো লক্ষণ হলো-তার বুকে জমে থাকা কফ পরিষ্কার হচ্ছে। নিউমোনিয়োয় আক্রান্ত হওয়ায় কফ জমে ছিল। গতকাল তার স্বাস্থ্যের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়েছে। যেখানে প্যারামিটারগুলো ভালোর দিকে যাচ্ছে। মেডিকেল বোর্ড এতে স্বস্তি প্রকাশ করেছে। সূত্রটি জানায়, শুক্রবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে এম্বুলেন্সযোগে বিমানবন্দরে নেয়া হবে। কিছু প্রক্রিয়া শেষ করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা করা সম্ভব হবে।
গতকাল বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কাতার আমীর নিজের উদ্যোগে তার মহানুভবতায় আমরা একটা অত্যন্ত উন্নতমানের এয়ার এম্বুলেন্স পেয়েছি। যেটা আজকে (বৃহস্পতিবার) রাতের মধ্যেই এখানে এসে পৌঁছাবে এবং সম্ভবত খুব ভোরেই বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে তারা যুক্তরাজ্যে চলে যাবে। আনুষঙ্গিক যে সমস্ত কাজগুলো দরকার, সেই কাজগুলো আমরা সেরে ফেলেছি এবং এখান থেকে ম্যাডামের সঙ্গে একটি চিকিৎসক দল যাচ্ছেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, কাতারের আমীরের এয়ার এম্বুলেন্সটি অত্যন্ত আধুনিক একটা এয়ার এম্বুলেন্স। এর মধ্যে অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থাই রয়েছে। আমরা পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে এই দোয়া চাচ্ছি, যে আল্লাহতায়ালা তাকে যেন নিরাপদভাবে নিয়ে যান এবং সুস্থভাবে আমরা যেন তাকে আমাদের মাঝে ফিরে পেতে পারি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী, গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী এবং এই মুহূর্তে দেশের দলমত নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের কাছে যিনি একজন অভিভাবক হিসেবে পরিচিত এবং যার অসুস্থতার কারণে সারা দেশের প্রতিটি মানুষ তার জন্য দোয়া করছেন তার রোগমুক্তির জন্য, তার উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশি-বিদেশি ডাক্তারদের নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে তাকে যুক্তরাজ্যের একটি উন্নত হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও স্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এর আগে দুপুরে এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য এবং খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, দেশবাসীকে অবগত করতে চাই, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থার আলোকে এবং সব কিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে কাতার রয়েল এয়ার এম্বুলেন্সের মাধ্যমে উনাকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অথবা শুক্রবার সকালের ভেতরে যুক্তরাজ্যে অর্থাৎ লন্ডনে একটি নির্ধারিত হসপিটাল ঠিক করেছি, সেখানে আমরা উনাকে নিয়ে যাবো। বেলা সাড়ে ১১টায় এভারকেয়ার হাসপাতালে বৈঠকে বসে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড। এতে যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসরকরা অংশ নেন।
তিনি বলেন, উনার যাওয়ার সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এবং বাইরের দু’জন চিকিৎসক উনার সঙ্গে থাকবেন। যাতে উনার যাত্রাপথে কোনো ধরনে প্রতিকূলতার মধ্যে সুস্থভাবে বিমানে চিকিৎসা দেয়া যায়, সেই লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমরা আজকে (বৃহস্পতিবার) মধ্য রাতের পরে অথবা ভোরের মধ্যে উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ ক্রমে।
জাহিদ বলেন, আমরা দেশবাসীসহ দেশের বাইরে হাজার-লক্ষ মানুষের কাছে দোয়া চাই। যারা দেশনেত্রীর সুস্থতায় দোয়া করেছেন। সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাদের এই দোয়ায় বেগম খালেদা জিয়াকে সুস্থ করে তুলবে। আমরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার সহধর্মিণী জুবাইদা রহমান এবং কন্যা জায়মা রহমান, ছোট ছেলের সহধর্মিণী সৈয়দা শার্মিলা রহমানসহ তাদের দুই কন্যা জাফিয়া ও জাহিয়া রহমান, উনার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দারসহ তাদের আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে দোয়া চাই, দেশবাসীকে কৃতজ্ঞা জানাই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টাগণ, সেনাবাহিনীসহ তিন বাহিনী প্রধান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এভারকেয়ার হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী, চীন, রাশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান দূতাবাসের সব ধরনের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন অধ্যাপক জাহিদ।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জাহিদ বলেন, আমরা মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করছি না। মেডিকেল বোর্ড বুধবার তিনবার ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করেছেন। ফিজিক্যালি উনাকে যুক্তরাজ্য ও চীনের ডাক্তাররা দেখেছেন। এই মুহূর্তেও যুক্তরাজ্যের ডাক্তার ও চীনের ডাক্তারদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমরা আল্লাহর রহমতে আশাবাদী, ইনশাআল্লাহ বেগম খালেদা জিয়া আল্লাহর অশেষ রহমতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, ইনশাআল্লাহ উনি আমাদের মাঝে ফেরত আসবেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও জুবাইদা রহমানের ঢাকায় আসার বিষয়ে নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন লিখেছেন, চলমান প্রক্রিয়ার প্রতিটি বিষয়, অর্থাৎ মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে নিয়মিত ব্রিফিং, লন্ডনের বিশেষায়িত হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, কাতারের এয়ার এম্বুলেন্সের প্রস্তুতি, খালেদা জিয়া এবং ডা. জুবাইদা রহমানের ভ্রমণের ব্যবস্থাপনা-সবকিছুর তত্ত্বাবধান করছেন তারেক রহমান।
চলতি বছরের ৭ই জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়া হয় কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেয়া রয়েল এম্বুলেন্সে করে। সেখানের লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন তিনি। চার মাস চিকিৎসার শেষে ৫ই মে কাতারের আমীরের দেয়া এয়ার এম্বুলেন্সেই দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
গত ২৩শে নভেম্বর থেকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন খালেদা জিয়া। তার ফুসফুসে সংক্রমণে অবস্থার অবণতি হলে গত ২৭শে নভেম্বর থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে চিকিৎকরা তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিবিড়ভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের একটি মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসা কার্যক্রম তদারকি করছেন। ৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাচ্ছেন ১৭ জন: বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডনে যারা যাবেন তাদের মধ্যে আছেন- বেগম খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান, সৈয়দা শার্মিলা রহমান, চিকিৎসক আবু জাফর মো. জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ এনামুল হক চৌধুরী, চিকিৎসক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী, চিকিৎসক মো. শাহাবুদ্দিন তালুকদার, চিকিৎসক নূরউদ্দিন আহমদ, রিচার্ড জন বিল, জিয়াউল হক, চিকিৎসক মো. জাফর ইকবাল, চিকিৎসক মোহাম্মদ আল মামুন, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) হাসান শাহরিয়ার ইকবাল, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের সৈয়দ সামিন মাহফুজ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সহকারী মো. আবদুল হাই মল্লিক, সহকারী ব্যক্তিগত সচিব মো. মাসুদুর রহমান, গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম ও গৃহকর্মী রূপা শিকদার।