Image description

সময়টা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। ডেপুটি চিফ অব স্টাফের (উপসেনাপ্রধান) দায়িত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আছেন কর্নেল জিয়াউর রহমান। এরই মধ্যে আমার পোস্টিংও হয়েছে ঢাকায়। ফলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়াকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। বেগম জিয়া তখন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী। তার সঙ্গে তখন কথা বলার সুযোগ হয়নি। এরপর সময় গড়িয়েছে। ১৯৯১ সালে আমি ছিলাম কাপ্তাইয়ের ব্রিগেড কমান্ডার। সে বছর অক্টোবরে হঠাৎ ফোন করে আমার কমান্ডিং অফিসার বললেন, ‘এসএসএফে তোমার পোস্টিং হয়েছে। তোমাকে এসএসএফের ডিজি হিসেবে ইমিডিয়েটলি যেতে হবে।’ এর আগেই নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এসএসএফে যুক্ত হওয়ার আগে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো কথাবার্তাও হয়নি। তিনি আমাকে চিনতেনও না ওইভাবে। উনার সঙ্গে প্রথম দেখাতে বললেন, ‘আপনি এসে গেছেন। ঠিক আছে। তাহলে কাজ শুরু করে দেন।’ জেনারেল এরশাদের সময় এসএসএফে যে কমান্ডটা ছিল সেটা একটু পরিবর্তন করার জন্য বলা হলো। ফলে তখনকার প্রথম সারির সিনিয়র অফিসারদের অনেকেরই পোস্টিং হয়ে গেল।

এসএসএফের প্রধান হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক ডিউটি শুরু হলো। তিনি যেখানেই যান আমাকে সেখানে থাকতে হতো। প্রথম দিকে উনার সঙ্গে আমার অনেক কথা হতো। এমনও হয়েছে কোনো একটি বিষয় জানার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলতেন। কোনো বিষয়ে যতটুকু যৌক্তিক মনে হয়েছে আমি সেভাবেই উনাকে বলেছি। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। হয়তো সেকেন্ড বা থার্ড অপিনিয়ন আমার কাছ থেকে নিয়েছেন। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছার ক্ষেত্রে এ মতামত চেয়েছেন। ক্রমেই বিভিন্ন বিষয়ে উনার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া বাড়ল।

বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার দেশের ভেতরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। দেশের প্রোগ্রামগুলোয় হেলিকপ্টারে চড়ে উনার সঙ্গে যেতাম। দিনের নানা সময় উনার প্রোগ্রাম থাকত। কিন্তু বিকালের প্রোগ্রামগুলোর ক্ষেত্রে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বিষয়টা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত। অনেক ক্ষেত্রে জনসভাগুলোয় উনি সর্বশেষ বক্তা হওয়ায় সেগুলো শেষ হতে দেরি হলে আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বলতাম, ‘দেখেন এই হচ্ছে কাট আউট টাইম। এরপরে হেলিকপ্টারে ওঠা যাবে না।’ হেলিকপ্টারের পাইলট যেটা বলত যে ঢাকা থেকে ওঠা কিংবা নামায় অসুবিধা নেই। কারণ সেখানে লাইটিং, সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং কমিউনিকেশন আছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে অন্ধকার হয়ে গেলে হেলিকপ্টার টেক অফ বা ল্যান্ডিং করানোটা খুব কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়তাম। যদিও বেগম খালেদা জিয়াকে কখনো দুশ্চিন্তায় পড়তে দেখিনি। উনার মধ্যে হয়তো নিরাপত্তা নিয়ে আস্থাটা ছিল। একবার চিটাগাং থেকে আসতে রাত হয়ে গেছে। পেছনে যে হেলিকপ্টার ছিল সেটা ঝুঁকির মধ্যে থাকায় ল্যান্ড করতে হচ্ছিল। উনাকে তো এ বিষয়ে বলিনি। সেদিন খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম।

 

নানান বিষয়ে তথ্য পেলেও একবার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আমরা একদমই অবগত ছিলাম না। সেটি হলো ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর উনি যে পদত্যাগ করবেন সেটি এসএসএফের প্রধান হয়েও আমি জানতাম না। উনি খুব ইনার সার্কেলে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি তিনি মূলত রাজনৈতিক কারণে দিয়েছিলেন। তখন তো আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যদের আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো ঘটনা ঘটেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তারা আন্দোলন করে। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে উভয় দিকেই দাবি ছিল। সে সময় দুই দলের মধ্যে আপস-মীমাংসা করতে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু যখন তা হলো না তখন বোধ হয় খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলটা পাস করানোর। সেজন্যই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি হয়। যার জন্য পরবর্তী সময়ে পল্টনের এক সমাবেশে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন। উনি যে পদত্যাগ করবেন সেটি আমরা জানতাম না। উনার খুব ঘনিষ্ঠ সার্কেল জানত।

সেনাবাহিনীতে বেগম খালেদা জিয়ার ভীষণ রকম গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ট্রুপসের কাছে তিনি প্রথমত মিলিটারি অফিসারের স্ত্রী, দ্বিতীয়ত তার স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান। সেই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতির স্ত্রীও ছিলেন। উনিও সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানগুলো পছন্দ করতেন। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তরুণ সৈনিকদের বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিয়েছেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে যেতেন। এটা তো তাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিল।

সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই তার জন্য দোয়া করছেন। এর পেছনের কারণ উনার সংগ্রামী জীবন। এরশাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বছরের পর বছর আন্দোলন করে গেছেন। এছাড়া গত ১৫ বছরে যে জীবন তিনি যাপন করে গেছেন সেটিই তাকে দল, দেশ ও জাতির কাছে টাওয়ারিং পারসোনালিটি হিসেবে তুলে ধরেছে। উনার উপস্থিতিই সবার মধ্যে আস্থা তৈরি করে। যার জন্য উনিই পারেন জনগণের মধ্যে সেই আস্থাটা ফিরিয়ে দিতে।

মেজর জেনারেল (অব.) জামিলউদ দীন আহসান, বীর প্রতীক: এসএসএফের সাবেক ডিজি (১৯ অক্টোবর ১৯৯১-২৬ জুলাই ১৯৯৬)