Image description

বিএনপির দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন নেতারা ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ ও নানা কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে অন্তত ২০টি আসনে বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে আভাস মিলেছে। ওইসব আসনে বিভেদ রেখা মুছে দিতে না পারলে দলীয় প্রার্থীরা বড় বিপদে পড়তে পারেন বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। 

এ নিয়ে দলের ঘরে-বাইরে চাপের মুখে রয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপিকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে এখনই শক্তিশালী দলীয় ঐক্য ও মাঠের বিরোধ নিষ্পত্তি জরুরি বলে মনে করছেন নেতারা। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গেল ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে বিএনপি। এর পর থেকেই মনোনয়ন ঘিরে অর্ধশতাধিক আসনে প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দেয়। অনেক এলাকায় জ্বালাও-পোড়াও করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থক। কোথাও কোথাও সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন। দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিরোধ নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান সমাধান চোখে পড়ছে না। উল্টো গাত্রদাহের মাত্রা ছড়িয়ে পড়ছে অন্য কিছু আসনে।

পদবঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ, মনোনয়নের ক্ষেত্রে যেসব মাঠ জরিপ, বিভাগীয় সাংগঠনিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে, সেখানে ঘাপলা ছিল। সিন্ডিকেটের কারণে মাঠের প্রকৃত চিত্র দলের শীর্ষ পর্যায়ে যায়নি। বিগত দিনে যারা হামলা-মামলার শিকার; আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে সক্রিয় ছিলেন; নেতাকর্মীকে আগলে রেখেছেন, তাদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী, নিষ্ক্রিয় কিংবা অনেক বিতর্কিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, নিরপেক্ষ জরিপের মাধ্যমে মনোনয়ন চূড়ান্ত করে প্রার্থী ঘোষণার সময় এখনও আছে। সে ক্ষেত্রে যদি দল পুনর্বিবেচনা না করে তাহলে তাদের অস্তিত্বের জন্য হলেও স্বতন্ত্র নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। এরই মধ্যে অনেক আসনে মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে কাজ করছেন। 

মনোনয়ন নিয়ে নেতাকর্মীদের এই মতানৈক্যে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সমকালকে তিনি বলেন, একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকলে একজনকে বেছে নিতে হয়। বাকিদের ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এটা প্রতি নির্বাচনেই হয়ে থাকে। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণার দিন স্পষ্ট করেছেন– এটি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা। স্থায়ী কমিটি যে কোনো সময় এতে বদল আনতে পারে।

মাগুরা-২ 
এরই মধ্যে মাগুরা-২ (শালিখা-মহম্মদপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও এই আসনের তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল। গত মঙ্গলবার বিকেলে শালিখা বিএনপির (একাংশ) উদ্যোগে আড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর মনোনয়ন দাবিতে আয়োজিত জনসভায় তিনি এ ঘোষণা দেন। 

এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। তাঁর মনোনয়ন ঘিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় বিএনপি। এরই মধ্যে শালিখা ও মহম্মদপুরের সাবেক দুই উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৯ ইউনিয়নের মধ্যে ১৮ জন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এবং সাম্প্রতিক ভোটে নির্বাচিত ইউনিয়ন-ওয়ার্ড কমিটির বিএনপির ৫১৩ নেতার মধ্যে ৫০১ জন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিতভাবে নিতাই রায়ের মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

সালিমুল হক কামাল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাত বছর জেল খেটেছি। আমার প্রথম লক্ষ্য দলীয় মনোনয়ন পাওয়া। না পেলে তৃণমূল নেতাকর্মীর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেব। 

নাটোর-১ 
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে ফারজানা শারমিন পুতুলকে। এরই মধ্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু। তিনি বলেন, যদি পুতুলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়, তবে আমরা আর অপেক্ষা করব না। স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচনে লড়ব। জনগণের ভালোবাসা আর নেতাকর্মীর শক্তি নিয়েই মাঠে নামব।

তাইফুল ইসলাম টিপু অভিযোগ করেন, রাজপথে যারা ছিলেন, যারা দলের পতাকা বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদের বাদ দিয়ে একজন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। এটা ত্যাগী নেতাকর্মীর প্রতি অবিচার।

সুনামগঞ্জ-৩
সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ) আসনে যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এম কয়ছর আহমদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে এরই মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন। 

তিনি বলেন, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব শিগগিরই এলাকার মানুষদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের সামনে এ ব্যাপারে ঘোষণা দেব। এলাকার মানুষের চাপে আমি জেনে-বুঝেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

ময়মনসিংহ-৬
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়ীয়া) আসনে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আখতারুল আলম ফারুক ধানের শীষ পেয়েছেন। এ আসনে বিএনপির সাবেক এমপি প্রয়াত শামছ উদ্দিন আহমদের ছেলে তানভির আহমেদ রানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আখতারুল আলম ফারুক ও তানভির আহমেদ সম্পর্কে চাচাত ভাই। 

জামালপুর-১
জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ) আসনে প্রার্থী করা হয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক এমপি এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে। এ আসনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন বকশীগঞ্জ বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘জনগণ আমাকে চারবার ভোট দিয়ে উপজেলা পরিষদের দায়িত্ব দিয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা ও এলাকার উন্নয়নকে লক্ষ্য করেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দলীয় প্রতীকের বাইরে থেকেও মানুষ আমাকে ভালোবাসে। এটাই আমার শক্তি।’ 

চট্টগ্রাম-৪ 
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে সালাউদ্দিনকে প্রার্থী করার পর থেকে বিক্ষোভ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, এ আসনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা লায়ন আসলাম চৌধুরীর বিকল্প কেউ হতে পারেন না। এ আসনের মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা না করলে শেষ পর্যন্ত আসলাম চৌধুরী স্বতন্ত্র নির্বাচনে যাবেন বলে তাঁর নেতাকর্মীরা জানান। 

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা জহুরুল আলম জহুর বলেন, আসলাম চৌধুরী দলের জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন। দীর্ঘ ৯ বছর কারাগারে থাকার কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়েছেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আসলাম চৌধুরীর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য পুরো পরিবারের ওপর নির্যাতন করেন।

পাবনা-৩
পাবনা-৩ (চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর) আসনে বিএনপি প্রার্থী করেছে কৃষিবিদ হাসান জাফির তুহিনকে। এ আসনে সাবেক এমপি ও চাটমোহর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কেএম আনোয়ারুল ইসলাম ছাড়াও তাঁর ভাতিজা উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাসাদুল ইসলাম হীরার মধ্যে যে কোনো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। 

সুনামগঞ্জ-৫
সুনামগঞ্জ-৫ (দোয়ারাবাজার-ছাতক) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন মিলনকে। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার কারণে নেতাকর্মীর একটি বড় অংশ তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ আসনে প্রার্থী বদলের দাবিতে আন্দোলন চলছে। যদি প্রার্থীর পরিবর্তন না হয় তাহলে ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে নেতাকর্মীরা জানান। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান এম এ হান্নানকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি কামরুজ্জামান মামুনকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে আসছে তাঁর সমর্থকরা। কামরুজ্জামান উপজেলার ফান্দাউক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন তাঁর কর্মীসমর্থকরা। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ-বিজয়নগরের একাংশ) আসনে কারও নাম ঘোষণা করা হয়নি। এতে হতাশ এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী রুমিন ফারহানার অনুসারী নেতাকর্মীরা। এখানে জোটের শরিক কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে রুমিন ফারহানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। 

পটুয়াখালী-৩
পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসনটি সমমনা দল গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে দেওয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। এবারও জোটের কাউকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হলে এ আসনের বিএনপি নেতা হাসান মামুনের আরেকবার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এ আসনে নুরকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নেতাকর্মীর চাপে হাসান মামুন স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন গলাচিপা সদর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নাসির উদ্দিন।

টাঙ্গাইল-৩ 
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসিরকে মনোনয়ন দিয়েছে দল। সেখানে সাবেক এমপি ও মন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদ স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। 

চাঁদপুর-৪
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন লায়ন হারুনুর রশিদ। তাঁর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এমএ হান্নানের কর্মীসমর্থকরা। এমএ হান্নান স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। 

এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১২ ও ১৩, কুষ্টিয়া-৪, সিলেট-৬, দিনাজপুর-২ এবং নেত্রকোনা-৫ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত কয়েক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলে জোর আলোচনা রয়েছে।