Image description

যশোরের ছয়টি আসন ঘিরে নির্বাচনী উত্তাপ শুরু হয়েছে। জেলার ২৪ লাখ ৮৬ হাজারের বেশি ভোটারকে সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মাঠে সরব হলেও নিজেদের ভেতরেই বড় সংকটে পড়েছে বিএনপি। ছয়টির মধ্যে চার আসনে ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তারা ক্ষোভ প্রকাশ থেকে শুরু করে তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগÑ সবই এখন নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আওয়ামী লীগ সক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই; ফলে দীর্ঘদিন পর যশোরে মূল লড়াই গড়াচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের মুখোমুখি প্রতিযোগিতায়। দুই দলের প্রচার, কৌশল ও স্থানীয় ইস্যুতে প্রতিশ্রুতি আর নবীণ ভোটারদের আগ্রহÑ সব মিলিয়ে জেলার রাজনীতি নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।

যশোর-১ (শার্শা) : এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি মফিকুল হাসান তৃপ্তি। তিনি অনুসারীদের নিয়ে ভোটের মাঠে সরব রয়েছেন। কিন্তু অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহির, সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনসহ ক্ষুব্ধ অনেক নেতা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে প্রার্থী পরিবর্তন চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন। এখানে জামায়াত মনোনয়ন দিয়েছে কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আজীজুর রহমানকে। সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী তার সঙ্গে ভোটের মাঠে রয়েছেন।

এ আসনে ভোটার ৩ লাখ ৭,৮৯৫ জন। এখানে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আ.লীগের তবিবর রহমান সর্দার এবং ২০০১ সালে বিএনপির আলী কদর এমপি নির্বাচিত হন।

যশোর-২ (ঝিকরগাছা ও চৌগাছা) : এ আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী আমলে গুম ও হত্যার শিকার জেলা বিএনপির সাবেক অর্থ সম্পাদক নাজমুল ইসলামের স্ত্রী ঝিকরগাছা উপজেলা সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা সুলতানাকে। তিনি অনুসারীসহ পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে আছেন। এদিকে গত ১০ নভেম্বর চৌগাছা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম ও ঝিকরগাছার সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ নিপুণসহ দুই উপজেলার ৫২ নেতা প্রার্থী পরিবর্তন চেয়ে তারেক রহমান বরাবর আবেদন করেছেন। তাদের মতে, সাবিরা সুলতানাকে সহানুভূতি দেখিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীর বিপরীতে তাকে নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করা কঠিন হবে।

জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ। তিনি ছাত্রশিবিরের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ডা. ফরিদ ‘হেভিওয়েট প্রার্থী’।

এ আসনে ভোটার ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৩ জন।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ২০০১ সালে জামায়াতের মুহাদ্দিস আবু সাঈদ এখানে এমপি নির্বাচিত হন।

যশোর-৩ : সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়ন বাদে ১৪ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনকে জেলার ভিআইপি আসন হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাধারণত দলের শীর্ষ নেতারা এ আসনটিতে প্রার্থী হন। এ আসনে বিএনপির টিকিট পেয়েছেন খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ছেলে অমিত ছাড়া এ আসনে আর কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশী নেই। তাকে ঘিরে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছেন। অনুকূল পরিবেশে তিনি ফুরফুরে মেজাজে নির্বাচনী মাঠ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন ভিপি আব্দুল কাদের। তিনি ছাত্রজীবনে যশোরের ঐতিহ্যবাহী এমএম কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং ১৯৮১-৮২ শিক্ষাবর্ষে কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন।

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন তাদের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা শোয়াইব হোসেনকে এ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনী মাঠে সরব রয়েছে।

এ আসনে ভোটার ৬ লাখ ৪১ হাজার ৬৬৮ জন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের রওশন আলী, ১৯৯৬ সালে আলী রেজা রাজু এবং ২০০১ সালে বিএনপির তরিকুল ইসলাম এমপি নির্বাচিত হন।

যশোর-৪ : বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও সদরের বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব। তিনি পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে সরব রয়েছেন। এ আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী অভয়নগর বিএনপি সভাপতি ফারাজী মতিয়ারের অনুসারীরা প্রার্থী পরিবর্তনের ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমেছেন। যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগও মাঠে আছেন।

এখানে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুলকে। তিনি জেলার সাংগঠনিক অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রচারে বেশ ব্যস্ত। এ আসনে ভোটার ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৯০। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাহ হাদিউজ্জামান, ২০০১ সালে জাতীয় পার্টির এমএম আমিন উদ্দিন এখানে এমপি নির্বাচিত হন।

যশোর-৫ : মণিরামপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপি কোন প্রার্থী দেয়নি। জোট হলে সাবেক মন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাসের ছেলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব মুফতি আব্দুর রশিদ বিন ওয়াক্কাস প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী উপজেলা সভাপতি শহীদ মো. ইকবাল, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমএ গফুর ও উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মিন্টু।

এখানে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট গাজী এনামুল হক। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী নিয়ে তিনি নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন।

এ আসনে ভোটার ৪ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬ জন। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের খান টিপু সুলতান এবং ২০০১ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ওয়াক্কাস এমপি নির্বাচিত হন।

যশোর-৬ (কেশবপুর) : আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। তার বাবা কাজী রফিকুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। তার পরিবারের আরও ডজনখানেক ব্যক্তি আওয়ামী রাজনীতির প্রথম সারির পদপদবিধারী। আওয়ামী পরিবারের ছেলে বিএনপির রাজনীতি করায় পরিবারও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পর থেকে তিনি অনুসারীদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠে আছেন।

গত ১৪ নভেম্বর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকসহ উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রথম সারির শতাধিক নেতাকর্মী প্রার্থী পরিবর্তন চেয়ে তারেক রহমানকে চিঠি দেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু, উপজেলা সভাপতি আবুল হোসেন আজাদও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক মোক্তার আলী। তিনি এলাকায় জনপ্রিয় ও প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন।

এ আসনে ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৭১ জন। এখানে ১৯৯১ সালে জামায়াতের মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের এএসএইচকে সাদেক এমপি নির্বাচিত হন।

কেশবপুরের আব্দুল ওহাবসহ কয়েকজন প্রবীণ ভোটার বলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে থাকছে না তা বলা যায়। তাই মূল লড়াইটা হবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কৌশলে সাধারণ আওয়ামী লীগ, স্বাধীন (যিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন) ও নবীণ ভোটারদের যে দল কাছে টানতে পারবে তারা বেশি সুফল পাবে।’

যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদ ইকবাল, রবিউল ইসলাম তাহিরা তাবাসসুম বলেন, ‘দেশের বড় একটি অংশ বিশেষ করে নবীণরা প্রায় দেড় যুগ ভোট দিতে পারেনি। সেই সময় আ.লীগের পাতানো ভোট হওয়ায় ভোটের প্রতি আগ্রহ ছিল না। নতুন প্রজন্ম নতুন বাংলাদেশ এনেছে। এবার নতুন ভোটারও হয়েছি। এই তরুণ ভোটারাই বেঁছে নেবে আগামীর নেতৃত্ব।’

যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘মনোনয়নবঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা থাকতেই পারে। তবে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে নেতাকর্মীরা ব্যক্তি নয়; সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবেন।’

জামায়াতে ইসলামীর জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল বলেন, ‘সংগঠনের নির্দেশনা মোতাবেক আমিসহ জেলার অন্য প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সরকারের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জোর দাবি জানাচ্ছি।’