রাজধানীর মহাখালী কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়েছেন কয়েক শত মানুষ। শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবার। মঙ্গলবার বিকালের দিকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ধরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালায় ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট। এ ঘটনায় কোনো হতাহত ও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও পুড়ে যায় শতাধিক বাড়িঘর ও সব মালামাল। তবে এখন পর্যন্ত আগুনের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে সেটি জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে আগুনের খবর পেলেও যানজটের কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ফায়ার সার্ভিসের ৪০ মিনিট লেগে যায়। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। পর্যায়ক্রমে ইউনিট সংখ্যা বাড়িয়ে ২০টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করে। রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
বস্তির বাসিন্দারা জানান, কেউ ছিলেন কাজে, কেউ ঘুমিয়ে। আবার কেউ কাজ শেষে ফিরছিলেন ঘরে। এরইমধ্যে হঠাৎ আগুন লাগার পর দাউ দাউ করে তা টিনের ঘরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত মানুষজন যে যেভাবে পারছেন, ঘর থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র সরিয়ে নেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ বস্তির বাসিন্দাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি, যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বা দুর্ঘটনা না ঘটে। তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
আগুনের ভয়াবহতা, তীব্রতা ও লেলিহান শিখা ছেয়ে যায়। চারদিকে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ে। এই মানুষের ভিড়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে এবং কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। পানি সংকটের কারণে কড়াইল বস্তির পাশে থাকা ছোট খালে মেশিন দিয়ে পানি তুলে আগুন নির্বাপণে ব্যবহার করার চেষ্টা করছিলেন। প্রতি মুহূর্তে যেন বেড়েছে আগুনের ভয়াবহতা। আশপাশে যাদের ভবন রয়েছে সবাই যার যার ভবনের উপর উঠে তাদের বসতবাড়ির যে পানির ব্যবস্থাপনা রয়েছে সেটি থেকে যে যেমন পারছিলেন তেমনিভাবে সহযোগিতা করছিলেন। বস্তিতে বসবাসরত বেশির ভাগ মানুষই তাদের ঘরের কোনো কিছুই নিয়ে বের হতে পারেননি। সরজমিন দেখা যায়, বস্তিতে বসবাসরত অনেকে শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন। যে যেটা হাতের সামনে পাচ্ছিলেন সেটি নিয়ে নিরাপদে রাখছিলেন। কেউ কেউ হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। এখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমজীবী মানুষগুলো এসে বসবাস করতেন। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে কড়াইল বস্তিতেই থাকতেন। কিন্তু ভাগ্য বারবার তাদের নিঃস্ব করে দেয়। ব্যাপক পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এসব নিম্ন আয়ের মানুষের। মাথায় করে শেষ সম্বলটুকু বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন এক নারী। এসময় তিনি স্বজনদের কাছে ফোনে আহাজারি করছিলেন। ওই নারী বলেন, সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। এখন কি হবে আমাদের? কোথায় যাবো আমরা। এক বৃদ্ধা বলেন, সব শেষ হয়ে গেছে। আমি গুলশানে ছিলাম। এখানে এসে দেখি আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে। এখানে অনেক ঘর রয়েছে- প্রায় শতাধিক। ঘটনাস্থলে থাকা এক ব্যক্তি জানান, এখানে সমস্যা হচ্ছে মানুষ প্রচুর। আগুন লাগছে অনেকক্ষণ হয়েছে, এখানে শুরুতে যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকবে তার কোনো সুযোগ ছিল না। একদিকে ভিড় অন্যদিকে রাস্তা চাপা। অনেক দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে পাইপ লাগিয়ে পানি আনতেও সময় লেগেছে অনেক।
জসীম নামে একজন তার মাকে মোবাইলে বলেন, ‘সব শেষ মা, সব শেষ। শুধু জানটা নিয়ে কোনোরকম বেরিয়েছি। কোনো কিছুই বের করতে পারিনি। ঘরে তালা দেয়া। তিনটা পুতেরে খুঁজতে খুঁজতে জীবন শেষ, তাদের এসে গাছতলায় পেয়েছি। আমাদের বাসার সামনের বাসা থেকে আগুনটি লেগেছে মা। আমি কি আগে মালামাল বের করবো নাকি নিজের জান বাঁচাবো। দূরে আগুন লাগলে তাও কিছু জিনিসপত্র বাঁচাতে পারতাম। এমন পরিস্থিতি ছিল কিছুই বের করতে পারছি না। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কোনো কাগজপত্রও বের করতে পারিনি। এখন আর কি করার- গ্রামে চলে আসবো। তিনি বলেন, আমি বের হয়েছিলাম বাজার করতে। সেখান থেকে ফিরে দেখি এই অবস্থা। আগুন কীভাবে লেগেছে সেটি এখনো জানি না।
আগুনে ঘর পুড়েছে বস্তির বাসিন্দা লাভলী বেগমের। তিনি বলেন, আমার সব আগুনে পুড়ে শেষ। সাত বছর ধরে এই বস্তিতে আছি। অনেক কষ্টে তিল তিল করে জিনিসপত্র কিনেছিলাম। ঘরে টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র কিনেছিলাম। মাসে মাসে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। লাকি আক্তার পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিনি বলেন, শুনেছি আমার ঘর পুড়ে গেছে। সব জিনিস নাকি পুড়ে গেছে। এখন আমি কীভাবে কী করবো, বুঝতে পারছি না।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানান, ঘটনাস্থলে পানির সংকটের কারণে পানিসহ আরও কয়েকটি ইউনিট পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, পানি সংকটের কারণেই আমরা ইউনিট বাড়িয়ে মোট ১৬টি করেছি। আমাদের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।
এর আগে চলতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এই বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় অসংখ্য ঘর। গত বছরের ২৪শে মার্চ ও ১৮ই ডিসেম্বরেও আগুনে পুড়ে কড়াইল বস্তি। প্রায় নব্বই একর জায়গার ওপর ১০ হাজারের মতো ঘর রয়েছে এই বস্তিতে।