ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইসলামি দলগুলোর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঐক্যের প্রশ্ন। হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ইসলামি দলগুলো এখন নিজেদের মধ্যকার মতভেদ ভুলে চালিয়ে যাচ্ছে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই), খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলো তাদের দলীয় সভা-সেমিনারে নানা বক্তব্যে এ ঐক্যের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের ভাষ্য, জনগণের পরিবর্তনের যে জোয়ার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে, তা ইসলামি নেতৃত্বের হাত ধরেই সফল হতে পারে। ফলে অতীতের বিভক্তি ভুলে এখন একটাই লক্ষ্য ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ দেশ গড়া। একইভাবে তৃণমূল কর্মীরা মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ না হলে ইসলামি রাজনীতির সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
এ ঐক্যের আলোচনার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান চরমোনাই সফর করেছেন। সেখানে চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক দূরত্ব থাকা এ দুই দলের এমন সম্পর্কও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম নিয়েছে নতুন আলোচনা। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে এমন একটি সাক্ষাৎকে অনেকেই ঐক্যের সম্ভাবনা হিসেবেই দেখছেন। এ সফরে উভয়পক্ষের নেতারা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
দেশের ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রসঙ্গে জনসাধারণের কাছে দোয়া চেয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।
জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা মূলত ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একতা দেখতে চাই। আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়ে আর কোনো প্রহসনের নির্বাচন হতে দেব না। তাই যথাযথ সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৯১ জন নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাকি ৯ ভাগের মধ্যে কিছু ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও কিছু নাস্তিকও থাকতে পারে। সব মিলিয়ে, এ বাংলাদেশ আমাদের।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্ণ হলেও আমরা স্বাধীন দেশের মর্যাদা পাইনি। এর মূল কারণ হলো দুর্নীতি ও দুঃশাসন। যেখানে আল্লাহর বিধান থাকবে না, সেখানে দুর্নীতি ও অশাসন আসবেই। নামাজের বিধান মেনে যদি আমরা সমাজে আল্লাহর বিধান মানতাম, তাহলে দেশের এমন অবস্থা হতো না। কিছু মানা ও কিছু না মানার কারণে দেশ এ অবস্থায় এসেছে। আমরা পুরোপুরি আল্লাহর বিধান মেনে চলতে চাই, তাই আমরা দেশবাসীর সহযোগিতা চাই।’
এর আগে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম। অন্যদিকে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক।
এদিকে ইসলামি দলগুলো ঐক্য প্রসঙ্গে খোলা কাগজের সঙ্গে কথা বলেন কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন জানান, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘ঐক্যের বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামি আন্দোলন (চরমোনাই) ও জামায়াত ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে কিছু প্রাথামিক আলোচনা চলছে।’ জামায়াতের সঙ্গে কওমি ধারার ইসলামি দলগুলোর ঐক্য; সেটা কেমন হতে পারে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আকিদাগত কিছু দূরত্ব তো আছে। তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তো আমরা ঐক্যের জায়গায় ছিলাম। সেই ঐক্যকে আমরা আরো সুসংহত করতে চাই। সে চিন্তা থেকেই সব ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের পথে হাঁটছেন। প্রয়োজনে এ ঐক্যে জাতীয় নির্বাচনও একসঙ্গে হতে পারে।’
ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘মূলত দেশের জনগণ চাচ্ছে আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলো এক হয়ে আসুক, এটা মানুষের একটা চাহিদা। কারণ বিগত দিনে দেশের মানুষ সব দলকেই দেখেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সবার শাসনামল সাধারণ মানুষের দেখা শেষ, এখন জনগণ বিকল্প চায়। আর ইসলামি শক্তিকেই সাধারণ মানুষ উত্তম মনে করে। এ উপলব্ধিটা সব ইসলামি দলের তৈরি হয়েছে। এখন ঐক্য হলেও এটা হবে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তবে নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে এটার ওপর নির্ভর করছে বাকি সিদ্ধান্ত।’
জামায়াত আমিরের চরমোনাই সফর ও দুই দলের মতাদর্শ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে তো আমরা এক আছি। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই। ইসলামের আলোকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র চায়। আর সব ইসলামি দলেও একই চাওয়া।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের খোলা কাগজকে বলেন, ‘ইসলামি দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমি আশা করি একটা ঐক্য হবে। একটা প্রক্রিয়া চলছে। এখনই ঐক্য হয়ে যাবে এমন নয়, তবে আমরা আশাবাদী।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের উদ্যোগ ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে। বিশেষত জাতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় দলগুলোর ভূমিকা বাড়াতে হলে তাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। অপরদিকে সাধারণ জনগণ এবং উভয় দলের কর্মীদের মধ্যে এ সফর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ মানুষ বিষয়টি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।