চট্টগ্রামের রাউজানের আওয়ামী লীগ দলীয় একজন প্রভাবশালী নেতা তার স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যানকে র্যাব দিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তবে এলিট ফোর্সটির তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপরই হাসিনুরকে র্যাব-৭ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ঢাকাটাইমসের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এসব তথ্য জানান গুমের পর আয়নাঘরে বন্দি থাকা সেনাবাহিনীর সাবেক লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান।
হাসিনুর রহমানকে বলা হতো তিনি পার্শ্ববর্তী একটি দেশের প্রতি বিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তা। আসলেই কি তাই? হাসিনুর রহমান বলেন, ‘বাস্তবতা হলো আমাদের পাহাড়ে যেসব উপজাতি আছে, তাদের একটা অংশকে বারবার উত্তপ্ত করে প্রতিবেশী দেশটি। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করে তারা। এসব সহায়তা পাওয়া সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রায়ই আমাদের সেনাবাহিনী, আনসার, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ কারণে দেশের অনেকের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আছে।
হাসিনুর বলেন, ‘ভারতের ‘র’ আমার সাথে কাজ করার জন্য বহুবার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা পারেনি। ২০০৮ সালে আমাকে বলা হয়েছিল এখন থেকে আওয়ামী লীগের সুবিধা দিতে হবে। আমি রাজি হইনি। এরপরই আমাকে টার্গেট করা হয়।’
ওই বছরের শেষ দিকে রাউজানের আওয়ামী লীগ দলীয় এক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর (তখনো এমপি হননি) সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় র্যাব কর্মকর্তা হাসিনুর রহমানের। এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘ফজলে করিম চৌধুরী একটি অপ্রীতিকর আবদার নিয়ে আসেন আমার কাছে। ক্রসফায়ার করতে হবে তার একজন ইউপি চেয়ারম্যানকে। তার নাম জাফর। আমি তাকে গ্রেপ্তার করি, কিন্তু ফজলে করিমের দাবি তাকে ক্রসফায়ার দিতে হবে ‘
জিজ্ঞাসাবাদে চেয়ারম্যান জাফর তখন হাসিনুর রহমানকে বলেছিলেন- ‘স্যার, আমি জানি ফজলে করিম আমাকে ধরিয়েছে। কারণ, আমার কাছের এক আত্মীয়কে গুলি করে হত্যা করতে বলেছেন তিনি, যা আমি করছি না। তাই ফজলে করিম আমাকে র্যাব দিয়ে ধরিয়েছে। আমি তার লাঠিয়াল’।”
এ সময় জাফর চেয়ারম্যানের কাছে অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে জানতে চান হাসিনুর রহমান। ফজলে করিম অন্তত এক ডজন একে-৪৭ এবং একটি এলএমজি দেন জাফর চেয়ারম্যানকে। এ তথ্য জেনে লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান চেয়ারম্যানকে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এরপর অস্ত্রগুলো উদ্ধারের চেষ্টায় মনোযোগী হন হাসিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এটা কোনোভাবে জেনে যান ফজলে করিম। তিনি বুঝে যান আমি অস্ত্রগুলো উদ্ধার করলে তার নির্বাচনে সমস্যা হবে। এরপরেই আমাকে র্যাব থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। এই থেকে তার সঙ্গে বিরোধ শুরু।’
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে চলে যান ফজলে করিম। গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় তাকে আটক করে বিজিবি। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন রাউজানের সাবেক এই সংসদ সদস্য।
দেশে গুমের শিকার আলোচিত ব্যক্তিদের একজন লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান। প্রথমে তাকে ৪৩ দিন গুম করে রাখা হয়। পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কোর্ট মার্শাল করে তার বিরুদ্ধে।
কেন তাকে গুম করা হলো। এর পেছনে কারা জড়িত থাকতে পারে। ঢাকাটাইমসের এমন প্রশ্নে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না প্রথমবার আমি গুম হয়েছি সেনাবাহিনী থেকে। আমাকে নিয়ে যায় অজানা জায়গায়। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কেউ জানে না কোথায় আছি। প্রথমবার আমাকে ৪৩ দিন গুম করে রাখা হয়। ফ্লোরে হ্যান্ডকাপ লাগানো, চোখ বাঁধা ছিল এ সময়।’
হাসিনুর রহমান বলেন, ‘পরে আমাকে কোর্ট মার্শাল করে জেলে পাঠায়। জেলে পাঠানোর প্রধান কারণ আমি র্যাবে ছিলাম।‘
বিভিন্ন ইস্যুতে হাসিনুর রহমানকে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করতে বলা হতো। এমনকি ভারতের র তাকে পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করত বলে জানান লে. কর্নেল হাসিনুর। তার ভাষ্য, ‘২০০৯ সালে র্যাবে থাকতে দেখেছি ওই নির্বাচন (নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন) ছিল সেটআপ করা। ২০০৮ সালে আমাকে বলা হয়েছিল এখন থেকে আওয়ামী লীগের সুবিধা দিতে হবে। সেটাতে আমি রাজি হয়নি। ‘র’ আমার সাথে কাজ করার জন্য বহুবার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা পারেনি। এরপরই ওরা টার্গেট করে। আমাকে ধরলে ওদের সমস্যাটা সহজ হয়ে যাবে। না হলে কঠিন হয়ে যাবে।’
হাসিনুর রহমান বলেন, ‘র্যাব থেকে বদলি হয়ে ময়মনসিংহে নিজ বাহিনীতে ফিরে যাই। এরপর বিডিআরে হত্যাযজ্ঞ হয়। তখন এই ঘটনা নিয়ে বেশ সরব ছিলাম। এটাতে ভারত জড়িত, আওয়ামী লীগ পুরোপুরি প্লানে জড়িত। তার চেয়ে হৃদয়বিদারক হলো সেনাবাহিনী তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেনি। এরপর র্যাবকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। এটা ছিল খুব দুঃখজনক। তখন আমরা ৫৭ জন অফিসার হারিয়েছি। তখন অনেক অফিসার ক্ষিপ্ত হন। এসব অফিসারদের মধ্যে কাউকে কাউকে হত্যাচেষ্টার মামলায় জড়ায় তাপস।’
শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য এসব করা হয় বলে মন্তব্য করে হাসিনুর বলেন, ‘অনৈতিক সব চর্চা তার ক্ষমতার সময় করা হয়েছে। ভারতকে খুশি ও সেনাবাহিনীর কোমর ভেঙে দেবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছিল ফজলে নূর তাপস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমসহ আরও অনেকে।’
খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া নিয়েও কথা বলেন হাসিনুর। বলেন, ‘তখন একটা রক্তক্ষরণ (বিডিআর বিদ্রোহ) করা হয়েছে, সেটা শুকায়নি। অনেক সেনা অফিসারের চাকরি নেই। এর মধ্যে আবার খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। হাসিনা এমন কাজ করেছে, মনে করত ক্ষমতা তার আজীবন।’
হাসিনুর রহমান ১৯৮৪ সালের জুনে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ১০ম লং কোর্সে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনী, র্যাব ও বিজিবিতে কাজ করেন। কর্মজীবনে হাসিনুর রহমান ৪০টি অ্যান্টি-পারসনেল এবং অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন জব্দ করেন। এছাড়া উপজাতীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর রকেট লঞ্চার ও চার্জার জব্দ করেন। তাছাড়া নাইক্ষংছড়িতে অভিযান চালিয়ে ২০টি একে-৪৭ রাইফেল এবং প্রায় ৮ হাজার গুলি উদ্ধার করেন। কক্সবাজারে বোমা উদ্ধার ছাড়াও ২০০৬ সালে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সদস্যদের গ্রেপ্তারে পাহাড়তলী অপারেশনের নেতৃত্ব দেন হাসিনুর। তিনি আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডে নিযুক্ত ছিলেন।