বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের পর। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গত বছরের ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে নৃশংস দমন-পীড়নের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ৭৮ বছর বয়সী এই নেত্রীকে অনুপস্থিত অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের সেই আন্দোলনে ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান, যাঁদের অনেককেই গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে নিজের অবস্থান অটল রেখেছেন। রায়ের পর দেওয়া বিবৃতিতে তিনি নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করলেও যে কোনো দায় অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, তিনি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতা কখনই বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দেননি। একই সঙ্গে তিনি আইসিটির রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে উল্লেখ করেন।
দেশের বহু মানুষের কাছে তাঁর মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও ভারত তাঁকে প্রত্যর্পণ করবে না- এমন ধারণা রয়েছে। ফলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে অপেক্ষা করতে হতে পারে চূড়ান্ত সান্ত্বনার জন্য। তবে এই রায় বাংলাদেশের জন্য আরও গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের যেসব কাঠামো গত দেড় দশকে দৃঢ় হয়েছে, সেগুলো ভেঙে ফেলার সুযোগ এখন তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনা এখন দাবি করলেও তিনি যে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার, তাঁর শাসনামলেও ঠিক একই অভিযোগের মুখে পড়েছিল বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। ২০১০ সালে শেখ হাসিনা যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানপন্থিদের বিচার করার জন্য, পরবর্তী সময়ে সেটাই ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর বিচার করার জন্য। অভিযোগ রয়েছে- শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিয়ে তিনি আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করেছেন। এ প্রক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। বৃহত্তম ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয় ও পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পুরো দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হাসিনা অপসারণের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। কিন্তু ইউনূস নিজেও ২০২৪ সালে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, যা বহু পর্যবেক্ষকের মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০০৭ সালে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে হাসিনার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ নিয়ে গর্ব করলেও সমালোচকদের মতে এই আদর্শকে শাসন টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আইসিটির রায়ের ভিত্তিতে জামায়াতের বহু নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিশ্লেষকদের ভাষ্যÑ ধর্মনিরপেক্ষতা একসময় স্বাধীনতার আদর্শ ছিল, কিন্তু হাসিনার শাসনে সেটি হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রণের ভাষ্য, যেখানে বিরোধীদের মত প্রকাশ, সংগঠন ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়েছিল।
মানবাধিকার পরিস্থিতিও তাঁর শাসনামলে ব্যাপক সমালোচিত হয়। ২০০৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২ হাজার ৫৯৭ জনকে বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য। যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে; গুম, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সরকারের সমালোচনা করায় ২০২৩ সালে তাদের দুই প্রতিষ্ঠাতাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ২০১৮ সালে আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করায় গ্রেপ্তার হন।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ীÑ তিনি ড্রোন, হেলিকপ্টার ও গ্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেন। আন্দোলন দমনে সহিংসতা ও হাজারো গ্রেপ্তার ঘটনাগুলো গণঅসন্তোষকে আরও উসকে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর পতন ঘটে।
যদিও তাঁর শাসনের সমালোচনার শেষ নেই, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতায় তাঁর অবদানও উল্লেখযোগ্য। এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত করেন। ২০০৯ সালের পর অর্থনীতিতে তাঁর নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে যায়, জিডিপি ৪৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, আর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ চীনের পর দ্বিতীয় স্থানে ওঠে আসে। তবে সমালোচকদের মতে, উন্নয়ন ছিল অসম এবং সুবিধাভোগী ছিল মূলত ধনিক শ্রেণি। ভারতের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে।
গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের রেকর্ড বিতর্কিত। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে, কারণ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে অস্বীকৃতি জানান। ২০১৮ সালের নির্বাচনও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ; হাসিনা ৯৬ শতাংশ ভোট পান, বহু বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একজন বিশ্লেষক তখন মন্তব্য করেন, এটি ছিল ‘উন্নয়ন, কিন্তু গণতন্ত্রহীন’। বলা হয়, যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাংলাদেশ করেছিল তাঁর সঙ্গে ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচার গ্রেপ্তার, সংবাদ মাধ্যমকে স্তব্ধ করে দেওয়া, বিরোধী দলকে চুপ করিয়ে দেওয়া এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠনগুলোকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেওয়া। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও বিরোধী দলগুলোর ওপর হামলা, গ্রেপ্তার ও কঠোর দমন-পীড়ন চলে। নির্বাচনের পর তিনি বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ ঘোষণা করেন; কিন্তু কয়েক মাস পর নতুন সরকার আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে নিষিদ্ধ করে।
এখন বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এতে লাখো সমর্থকের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং প্রতিহিংসার যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে, তারই ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে। একই সঙ্গে উদ্বেগের বিষয় হলোÑ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো ঘটনা নতুন সরকারেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করা ন্যায়বিচারের একটি প্রয়োজনীয় ধাপ হলেও বাংলাদেশের সামনে এখন বড় প্রশ্নÑ দেশ কি অতীতের প্রতিশোধমূলক রাজনীতি ছাড়তে পারবে? অতীতের ক্ষত সারাতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণÑ প্রতিহিংসামুক্ত গণতন্ত্র গড়ে তুলতেই হবে। এটি করতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতার চক্র থেকে বেরিয়ে নতুন পথ খুঁজে পাবে।