জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত থেকে পাঠানো লিখিত বিবৃতিতে তিনি রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’, ‘অবৈধ’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেন। তার অভিযোগ, ‘আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যায্য সুযোগ দেয়া হয়নি,’ এ ছাড়া তার পছন্দের আইনজীবীও আদালতে থাকতে পারেননি। ভারতের এনডিটিভি শেখ হাসিনার এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
হেগে নিজের বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘যথাযথ আন্তর্জাতিক আদালতে নিরপেক্ষভাবে বিচার হলে আমি ভীত নই। তাই বহুবার প্রস্তাব দিয়েছি, এ অভিযোগগুলো হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উপস্থাপন করা হোক।’
এ প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তার এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা পুরোপুরি অস্বীকার করছি। জুলাই-আগস্টের প্রতিটি মৃত্যুই আমাকে শোকাহত করেছে। কোনো আন্দোলনকারীকে হত্যা করার নির্দেশ আমি বা আমার কোনো সহকর্মী দিইনি।’ তিনি বলেন, বিচারটি তার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তিনি আত্মপক্ষ তুলে ধরতে পারেননি এবং এই পরিস্থিতিকে তিনি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ‘‘নামের মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দ থাকলেও আইসিটিতে আন্তর্জাতিক বলে কিছু নেই। এ আদালত নিরপেক্ষও নয়।” তার দাবি,- তার প্রতি সহানুভূতিশীল বিচারক বা আইনজীবীদের অপসারণ বা ভয় দেখানো হয়েছে, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নথিভুক্ত সহিংসতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি আর কেবল আওয়ামী লীগকেই লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। ড. ইউনূস সরকারের সমালোচনা করে বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহিংস, অগোছালো ও সমাজকে পিছিয়ে দেয়া প্রশাসন যে দুরবস্থা তৈরি করেছে, তার দায় আড়াল করতেই এই বিচার সাজানো হয়েছে।’
তিনি দাবি করেন, ‘কোটি কোটি মানুষ দুঃখ-কষ্টে আছেন; কিন্তু তাদের কেউই এই সরকারকে সমর্থন করেন না।’
তার ভাষায়, এই রায়ের উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগকে বলির পাঠা বানানো; আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা ঢেকে রাখা। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (১৯৭৩ সংশোধিত) অনুযায়ী পলাতক আসামির বিচার অনুপস্থিতিতে করার পূর্ণ বিধান রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় নোটিশ, প্রতিনিধিত্বের সুযোগ এবং রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগ করেছে। আদালত মনে করলে হেগে স্থানান্তরের প্রশ্নই আসে না, যেহেতু এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার আওতায় সংঘটিত অপরাধ।
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, অনুপস্থিতিতে বিচার সবসময়ই অতিরিক্ত সতর্কতা দাবি করে।
কেন এত কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেন শেখ হাসিনা- এ প্রশ্নে বিশ্লেষকদের মতে, এর কারণ হলো প্রথমত, ভারতমুখী কূটনৈতিক চাপ তৈরি। বিবৃতিটি ভারতীয় গণমাধ্যমে পাঠানো, এটি ইঙ্গিত করে তিনি ভারতের রাজনৈতিক মহলকে নিজের পক্ষে সক্রিয় করার চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়ত, সমর্থকদের মনোবল ধরে রাখা। মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আওয়ামী লীগ সংগঠনের ওপর বড় ধাক্কা এসেছে। বক্তব্যটি মূলত মূল সমর্থকদের ‘দমন-পীড়নের শিকার’ বয়ান দিয়ে সক্রিয় রাখার কৌশল।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক মহলে ‘পারসিকিউশন ন্যারেটিভ’। তিনি স্পষ্টভাবে দাবি করেছেন: এই বিচার রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত প্রতিশোধমূলক, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনুপযুক্ত, এনজিও ও মিডিয়া তার পক্ষে-
এই সবই আন্তর্জাতিক মহলে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা।
ভারত কী করবে- এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, যেহেতু শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামাল ভারতে আছেন, রায় কার্যকর করতে হলে বাংলাদেশকে প্রত্যার্পণ চুক্তি বা বিশেষ বন্দোবস্ত করতে হবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের প্রতিক্রিয়া, এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখবে। এখন কী ঘটতে পারে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।