২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়েছেন। সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে এই রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতি দেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী ‘১০০১ জন’ শিক্ষক।
জানা যায়, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্রদীপ স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০১ জন স্বাক্ষর করেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও ৬৩০ জন শিক্ষকের নাম যুক্ত করা হয়েছে। তবে বিবৃতিতে কোনো স্বাক্ষর ছিল না। অপরদিকে এখানে নাম থাকা অনেক শিক্ষক বলছেন, তারা এই বিবৃতির সঙ্গে জড়িত নন। তাদের নাম দেওয়া হয়েছে অনুমতি ছাড়াই। এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন তারা। আবার অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসও দিচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আওয়ামীপন্থী কোনো শিক্ষক ও শিক্ষক সংগঠনকে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। তবে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ৩৮১ জন শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেফতারকৃত আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতি/বহিষ্কার/সাময়িক বহিষ্কার এবং একাডেমিক ও প্রশাসনিক যেকোনো ধরনের শাস্তি বাতিলের দাবিতে এই বিবৃতি দিয়েছিলেন তারা।
এরপর আরও তিনটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল ড. মাহবুব আলম প্রদীপ স্বাক্ষরিত। সর্বশেষ আজ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাজানো রায় প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন ৬৩০ জন শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে। এর আগে গত ২৮ অক্টোবর মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের বিরুদ্ধে ৪৮১ জন শিক্ষকের বিবৃতি এবং ১৩ অক্টোবর শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলায় প্রগতিশীল ৪৭১ শিক্ষকের বিবৃতি দেয়া হয়েছিল।
এসব বিবৃতি ঘেটে দেখা যায়, প্রতিবারই শিক্ষকের নামের সংখ্যা বেড়েছে। ৩৮১ জন শিক্ষকের বিবৃতি দিয়ে শুরু এবং সর্বশেষ বেড়ে ৬৩০ জন হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে বিবৃতি প্রেরক হিসেবে স্বাক্ষর থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম প্রদীপের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মরজিনা বেগম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মাহবুব আলম প্রদীপ দীর্ঘদিন ধরে লিয়েন ছুটিতে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। লিয়েন হচ্ছে এক চাকরিতে বহাল থেকে অন্য চাকরি করা।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে থেকেই দেশের বাইরে লিয়েনে রয়েছেন। মাঝখানে শিক্ষা ছুটিতে থাইল্যান্ডে ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে আবার লিয়েন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। ৪ বছরের জন্য এই ছুটিতে তিনি আছেন বলে জানান।
ড. মাহবুব আলম প্রদীপের লিয়েন ছুটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষা ছুটির সময় একজন শিক্ষকের বেতন চালু থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ছুটি শেষে দেশে ফিরে অন্তত ঠিক ততদিন সার্ভিস দিতে হবে, যতদিন তিনি ছুটিতে ছিলেন। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ ফেরত চায়। মাহবুব আলম প্রদীপ ছুটির সমান সার্ভিস দেওয়ার আগেই লিয়েন ছুটি নিয়েছেন।
যদিও তিনি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই লিয়েন ছুটি নিয়েছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক মরজিনা বেগম বলেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পাওনা বাকি আছে। তিনি কিছু টাকা ফেরত দিয়েছেন আর কিছু বাকি রেখেছেন। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ফেরত দিবেন, এই কমিটমেন্টে দেশের বাইরে গিয়েছেন। তবে তিন মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত টাকা ফেরত দেওয়াসহ অতিসত্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার ব্যাপারে তাকে চিঠি দিয়েছে। তিনি এখনও যোগদান করেননি।
এদিকে আজকের বিবৃতিতে নাম রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। তবে তারা বলছেন, বিবৃতির বিষয়ে তারা তেমন কিছু জানেন না। নাম দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি করে বিব্রত করার জন্য। যারা এ কাজটি করেছেন তারা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে বহিস্কৃত নতুবা দেশের বাইরে আছেন এই মুর্হুতে। ৎ
এর প্রমাণ পাওয়া যায় তালিকা নাম থেকে। তালিকায় এক নম্বরে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত, ৫ নম্বরে থাকা অধ্যাপক ড. জিনাত হুদাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত। এছাড়া অধ্যাপক মশিউর রহমান, অধ্যাপক ড. আ. ক. ম. জামাল উদ্দিন, ড. নীলিমা আক্তারও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত।
তালিকায় নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মহীবুল আজিজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার ছেলে অসুস্থ। সকাল থেকে চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে তার পরীক্ষার হলের কাছে ছিলাম। রায় এবং বিবৃতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। বাসায় ফেরার পর একজনের কলে জানতে পারলাম যে একটি বিবৃতিতে আমার নাম রয়েছে। এ বিষয়ে পরে আমার ফেসবুক আইডিতে লিখে আমার অবস্থান স্পষ্ট করেছি।’
ফেসবুক পোস্টে অধ্যাপক মহীবুল আজিজ লিখেছেন, ‘আমি কোথাও কাউকে কোনো বিষয়ে কোনো মত দেইনি। যদি কেউ তা করে সেটা তারা করেছে আমার অনুমতি ছাড়া। আমি এই ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শেখ সাদী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনে বিভাগের এমএ পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলাম। ভবনটিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক ধীরগতির। বিকেলে বাইরে আসার পর একজন ফোন করে জানতে চাইলে আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হই। আমি এটিতে বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ। এ বিষয়ে আমার কারো সঙ্গে কথা হয়নি কিংবা বিবৃতি দিতে কাউকে সম্মতি দেইনি। সম্পূর্ণ আমার অজ্ঞাতে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনওয়ারুল ইসলাম ও প্রভাষক গোলাম কুদ্দুস লাভলু এক যৌথ বিবৃতিতে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম সংবলিত বিবৃতিতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের জানামতে আমরা এ ধরনের কোনো বিবৃতিতে স্বাক্ষর বা কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করিনি।’
তারা আরও লিখেছেন, ‘বিষয়টি আমাদেরকে হতাশ করেছে। উল্লেখ্য যে সকল ধরনের অতীতের নোংরা ও কলুষিত রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, ‘আমি নিজেই বিস্মিত তালিকায় আমার নাম দেখে। আজকে সারাদিন একাডেমিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কে বা কারা এটা করছে জানি না। তবে ধারণা করছি, বিদেশে থাকা কিছু লোক পড়াশোনা করতে গেছে তারাই কাজটি করছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে একটি রায় প্রত্যাখ্যান করে ১ হাজার অধ্যাপক স্বাক্ষর দিয়েছেন, যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে স্পষ্টভাবে জানানো যাচ্ছে যে আমার কোনো অনুমতি বা সম্মতি ছাড়াই এই বিবৃতিতে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বিবৃতিটির বিষয়ে আমাকে আগে কোনোভাবে অবহিতও করা হয়নি। তাই উক্ত বিবৃতিতে আমার নাম অন্তর্ভুক্তকরণ সম্পূর্ণ অননুমোদিত। আমি এ ধরনের প্রচেষ্টাকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করি।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফেরমেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক তাজুদ্দীন শিকদার ফেসবুকে লিখেছেন, এই বিবৃতি বা এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার সাথে কেউ কখনোই কোনো আলোচনা করেননি এবং আমার কোনো রকম অনুমতিও নেওয়া হয়নি। আমি এই সংক্রান্ত কোনো নথিতে স্বাক্ষর করিনি।’
বিবৃতিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন আওয়ামীপন্থী শিক্ষকের নামও রয়েছে। তবে তারা বলছেন, এই বিবৃতির বিষয়ে তারা অবগত নন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কে বা কারা এটা করেছে আমি অবগত নই। আমি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নই। মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক উমর ফারুক বলেন, এটা উড়ু চিঠির মতই তো হলো। আমি বিবৃতিতে সম্মত হলাম, অথচ নিজেই জানি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক লায়লা আঞ্জুমান বানু বলেন, হঠাৎ শিক্ষার্থীরা আমাকে বিষয়টি জানালো। জেনে অবাক হলাম। এটা তো কোন বিবৃতির পদ্ধতি না। যদি দিতাম, তাহলে তো আনুষ্ঠানিকভাবেই সেটা জানাতাম। এগুলো উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। চারুকলা অনুষদের ড. সুজন সেন বলেন, আমি জানিই না। হঠাৎ শুনে অবাক হলাম। এর সঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট নই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইনুল হক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নামের সাথে নাম মিলে যেতে পারে! ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে! মানবতাবিরোধী ঐতিহাসিক রায় নিয়ে কোনো ধরণের বিবৃতির সাথে আমার কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা নেই!’