ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় আজ ঘোষণা করা হবে। মামলার অন্য দুই আসামি হলো- তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল রায় ঘোষণা করবেন। রায়টি সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় দেয়া হবে এই ট্রাইব্যুনালে। এদিকে ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর আবারো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, শেখ হাসিনাসহ আসামিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেটা শহীদ পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার জন্যও আবেদন করেছেন। ট্রাইব্যুনাল ন্যায়বিচারের স্বার্থে যে আদেশই দিক না কেন, প্রসিকিউশন সেটা মেনে নেবে। এ মামলায় হাসিনা-কামালের সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও, মামুনের শাস্তি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মামলায় আসামি ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ) হয়েছেন। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এই মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ হওয়ার আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
গত বছরের ১৭ই অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। শুরুতে এই মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। প্রসিকিউশনের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৬ই মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি হিসেবে তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় গত ১২ই মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। পরে গত ১লা জুন আসামিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। এতে শেখ হাসিনাকে জুলাই-আগস্টে নৃশংসতার ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এই তিন আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো- গত বছরের ১৪ই জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান। হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১০ই জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ২৩শে অক্টোবর মামলাটির যুক্তিতর্ক শেষ হয়। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও ৩টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে দুটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপরটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার এস এম মইনুল করিম মানবজমিনকে বলেন, মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) পত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি, হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগে বিচারকাজ সম্পন্ন করেছে প্রসিকিউশন। আজ মামলাটির রায় প্রদান করা হবে। প্রসিকিউশন মনে করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। এজন্য আসামিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করা হয়েছে। তবে, মামলার আসামি আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন যেহেতু রাজসাক্ষী হয়েছেন, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি ট্রাইব্যুনালের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাই মামুনের ব্যাপারে প্রসিকিউশন কোনো প্রেয়ার দেয়নি। প্রসিকিউশন মনে করে রাজসাক্ষী হয়ে মামুন সত্য প্রকাশ করেছে। বিচারে ট্রাইব্যুনাল অ্যাপ্রুভারকে (রাজসাক্ষী) সম্পূর্ণভাবে মুক্তি অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন। এটি সম্পূর্ণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার।
এদিকে, আসামি চৌধুরী মামুনের খালাস চেয়েছেন নিজের অর্থে নিয়োগ করা আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমার আসামি রাজসাক্ষী হয়ে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া প্রসিকিউশন থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, চৌধুরী মামুন সত্য প্রকাশ করেছে। তাই আমি মামুনের অ্যাকুইটাল (খালাস) চেয়ে আবেদন করেছি। এখন ট্রাইব্যুনাল এটি বিবেচনা করবেন।
রায়ে নারী-পুরুষ সমান, অপরাধের ধরন বিবেচনায় শাস্তি দেয়া হয়: প্রসিকিউটর
গতকাল ট্রাইব্যুনালের এই প্রসিকিউটর জানান, রায় দেয়ার ক্ষেত্রে নারীর আলাদা প্রিভিলেজ (বিশেষ সুবিধা) নেই। সিআরপিসি আইন অনুযায়ী জামিনের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ ব্যক্তি ও কিশোরদের প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা রয়েছে। তবে রায়ের ক্ষেত্রে নারীকে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার বিধান সাধারণ কিংবা ট্রাইব্যুনাল আইনেও নেই। অর্থাৎ আসামি নারী নাকি পুরুষ তা বিবেচ্য নয়। বরং তিনি কী অপরাধ করেছেন সেই গ্রাভিটি বা গুরুতরতার ভিত্তিতেই শাস্তি নির্ধারণ হবে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আসামি খালাস পাবেন। তিনি আরও বলেন, আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে যে, যদি আসামি পলাতক হয় তাহলে রায়ের পর থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন। যদি তিনি গ্রেপ্তার হন অথবা ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেন। অন্যথায় স্টেট ডিফেন্সের কোনো এখতিয়ার নেই। যেসব আসামি এ মামলায় পলাতক রয়েছেন তারাও গ্রেপ্তার বা আত্মসমর্পণ ছাড়া আপিল করতে পারবেন না।