পুলিশের নতুন পোশাক নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে নেটদুনিয়ায় সর্বত্র এই নিয়ে নানা কথা বলছে মানুষ। কেউ ইতিবাচক বলছেন, আবার কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। বাহিনীটির নতুন পোশাক নিয়ে খোদ পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠার পর থেকে সমালোচনার মুখে থাকা পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও পোশাক পরিবর্তনের দাবি উঠলে অন্তর্বতী সরকার নতুন পোশাক অনুমোদন করে। এরই অংশ হিসেবে মহানগর পুলিশে লৌহ রঙের নতুন পোশাক দেয়া হয়েছে। শনিবার থেকে নতুন পোশাকে মাঠে নেমেছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোপলিটন এলাকায় ইতিমধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ পুলিশ সদস্যকে সরবরাহ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেয়া হবে নতুন পোশাক। তবে সাধারণ মানুষ মনে করেন, পুলিশের এই পোশাক পরিবর্তনের চেয়ে নৈতিক আচরণের দৃশ্যমান পরিবর্তন বেশি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পোশাক বদলালে হবে না, পুলিশকে হতে হবে জনবান্ধব। আর রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে আগের পোশাকেই দায়িত্ব পালন করছেন অধিকাংশ পুলিশ সদস্য। তবে বিভিন্ন অফিসসহ নতুন পোশাকে কয়েকটি স্থানে মাঠ পর্যায়েও দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে পুলিশকে। নতুন পোশাক ব্যবহারকারীদের অনেকে ইতিবাচক ভাবে দেখছেন। নতুন পোশাক পরিধান দায়িত্বরত একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এই পোশাক পরে খুবই ভালো লাগছে; তবে যখন মাঠ পর্যায়ে সবাই পরবে এটি আরও ভালো লাগবে। সরকার থেকে নির্ধারিত হয়েছে আমরা সেটি পরিধান করছি। পোশাক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবে; সবকিছু উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন এবং জনগণের সেবা প্রদানই হচ্ছে মুখ্য। নতুন পোশাক পরিধানরত আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, একটি প্রেক্ষাপটের কারণে পুলিশের পোশাকে পরিবর্তন হয়েছে এটা ভালো। শুধু পোশাক পরিবর্তন হলে হবে না, এখানে মন-মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে। মানবিক পুলিশ হতে হবে, জনগণের স্বার্থে জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকটি জিনিসেই আলোচনা-সমালোচনা থাকবে; তারমধ্যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে কেউ কেউ নেতিবাচকও ভাবছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সবেমাত্র নতুন পোশাক এনে রেখেছি; এখনো পরা হয়নি। পোশাক তো শুধুমাত্র উপরের একটি প্রতিচ্ছবি। তবে ব্যক্তিগতভাবে এই কালারটি কেমন যেন লাগছে। খুব একটা রুচিকর মনে হচ্ছে না। হয়তো পরতে পরতে ধীরে ধীরে এই রঙের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবো, তখন ভালো লাগবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, আমার মতে পুলিশের পোশাকের রঙের পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। আইন মোতাবেক তাদের কাজকর্ম করা জরুরি। সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে, জনগণের সঙ্গে ভদ্র আচরণ ও সুন্দর ব্যবহার করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় বৃটিশ আমলের ইউনিফর্ম পরে তারা এখনো কাজ করছে, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
সাইবার বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ মারাত্মকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গত ফ্যাসিবাদ টার্মে। এটার জন্য যেটি দাঁড়ালো, ওনারা কিন্তু মোর্যালি অনেক ডাউন এবং সেই পোশাক পরে যখন মানুষের সামনে আসে দুটো স্মৃতি কিন্তু চোখে ভেসে আসে। সুতরাং একটা বাহ্যিক পরিবর্তন, অর্থাৎ আগের পুলিশটাই নতুন পোশাকে নতুন ভাবে আসছে এটা পজেটিভ ভাবেই দেখছি। পুলিশের পোশাকের রং পরিবর্তনকে আমি স্বাগত জানাই। এটা শুধু বাংলাদেশের প্র্যাকটিস না, যখন কোনো বাহিনী বিতর্কিত হয়ে যায় অনেক সময় শুধু পোশাক নয়, নামও পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞানে একটা স্বীকৃত থিউরি করতেই পারে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, এখানে নতুন পোশাকের রঙের চেয়ে বরং পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল বা এখনো সেই অভিযোগ মুক্ত পুলিশকে মানুষ দেখতে চেয়েছে। রংয়ের চেয়ে কর্মকাণ্ডে নতুনত্ব আনাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এবং পুলিশের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাটাও জরুরি। বর্তমানে নতুন রংয়ের যে পোশাক এই পোশাক পরিধান করে যে পুলিশ অভিযোগ মুক্ত হয়ে অথবা বিতর্কিত মুক্ত থেকে যদি কাজ করতে না পারেন তখন তো নতুন পোশাকে তাদের আরও একটি সংকটের মধ্যে ফেলবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের আস্থার যে সংকট ছিল, জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে যারা সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়েছে, জনগণের সঙ্গে তাদের আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই রং দিয়ে সেই অভিযোগ বা বিতর্কের জায়গাটা সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবে না। মানুষের কাছে তাদের আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, পুলিশের নতুন রংয়ের পোশাক ১৫ই নভেম্বর থেকে কার্যকরী হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ পুলিশ সদস্যকে এটি সরবরাহ করা হয়েছে। আশা করছি, এই মাস নাগাদ আমরা সবাইকে নতুন পোশাক সরবরাহ করতে পারবো। অনেকে নতুন পোশাক পরিধান করে মাঠ পর্যায়েও কাজ করছেন। তিনি বলেন, সমালোচনা থাকবে, পুলিশের পোশাক নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে- এটা অবশ্যই ইতিবাচক একটা দিক। আসলে প্রত্যেকটি বিষয়ে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। যেহেতু একটা নতুন পোশাকে পুলিশ দায়িত্ব পালন শুরু করেছে- এটা দেখতে দেখতে মানুষের একটু সময় লাগবে। এটা আমাদের নৈমিত্তিক কাজে কোনো প্রভাব ফেলবে না। বরং এটা আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, শনিবার থেকেই নতুন পোশাকে পুলিশের দায়িত্ব পালন শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে সকল মেট্রোপলিটন পুলিশ ও পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এই পোশাক পেয়েছেন। জেলা ও রেঞ্জ পুলিশ পর্যায়ক্রমে নতুন এই পোশাক পরবেন। তবে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল প্রটেকশন ব্যাটালিয়নে (এসপিবিএন) আগের পোশাক থাকবে।