আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রামে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে জ্বলছেন দলের একাধিক শীর্ষ নেতা। তাদের অনুসারীরাও ক্ষোভ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। করছেন প্রতিবাদ। কোথাও সড়ক ও রেল অবরোধ, কোথাও মশালমিছিল; এমন নানা সহিংস ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে জেলা বিএনপির রাজনীতি। এসবে মদত রয়েছে বঞ্চিত নেতাদের। এমন কর্মসূচিতে ভোগান্তিতে পড়ছেন স্থানীয় লোকজন। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দলের নেতাকর্মীরাও।
গত ৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন। ঘোষিত তালিকায় চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ১০টিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। এই ১০টিতে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তারা হলেন- চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে নুরুল আমিন, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে সরওয়ার আলমগীর, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে কাজী সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখারী ও চান্দগাঁও) আসনে এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম-১০ (খুলশি-পাহাড়তলী) আসনে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে মোহাম্মদ এনামুল হক, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী।
তবে মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকে বেশ কয়েকটি আসনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ্যে দেখা দেয়। তার মধ্যে চট্টগ্রাম-৪ আসনে কাজী সালাউদ্দিনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত এই মহাসড়ক। মহাসড়কের দুই পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়েন হাজারো যাত্রী। শুধু সড়ক নয়, বিক্ষোভকারীরা রেললাইনেও অবরোধ সৃষ্টি করে কয়েকটি ট্রেন আটকে দেয়। এতে বেশ কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পরবর্তীতে দুই দফায় বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী অনুসারী সাত জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
এর রেশ না কাটতেই ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম-২ আসনেও দেখা দেয় একই চিত্র। ওই দিন বিকালে মনোনয়নবঞ্চিত আজিম উল্লাহ বাহারের অনুসারীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি ও ফেনী-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকে। দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ আসনে উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীরের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন আজিমের অনুসারীরা।
৬ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম-১৬ আসনেও দেখা যায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া। এই আসনে বিএনপি প্রার্থী মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী। মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতা লিয়াকত আলীর অনুসারীরা মশালমিছিল করে প্রতিবাদ জানান এবং প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তোলেন।
সর্বশেষ ১২ নভেম্বর রাতে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ ও মশালমিছিল এবং সড়ক অবরোধ করেছেন চট্টগ্রাম-১৩ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব লায়ন উদ্দিনের অনুসারীরা। ওই দিন সন্ধ্যায় আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী চৌমুহনী এলাকায় মশালমিছিল বের করা হয়। পরে চাতুরি চৌমুহনী থেকে শুরু করে কর্ণফুলী টানেল মোড়ে গিয়ে সমাবেশ করেন তারা। সেখানে সড়ক অবরোধ করে ওই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া সরোয়ার জামালের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের কারণে এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এভাবে একের পর এক আসনে মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ ও বিক্ষোভে চট্টগ্রাম বিএনপিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
ঘোষিত ১০টি আসনের মধ্যে চারটিতে মনোনয়নবঞ্চিত প্রার্থীর সমর্থকরা প্রকাশ্যে বিক্ষোভ করলেও বাকি ছয়টিতে দলীয় কোন্দল ও অসন্তোষে নীরবে পুড়ছেন নেতারা। মনোনয়নবঞ্চিতরা প্রার্থী পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
মনোনয়নবঞ্চিত ও অন্তত পাঁচ জন দলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন নুরুল আমিন। তার সঙ্গে গুলশানে ডাক পেয়েছিলেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক নুরুল আমিন ও উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক সাহেদুল ইসলাম চৌধুরী। এই দুই নেতার রয়েছে বিশাল সমর্থক-গোষ্ঠী। মনোনয়ন না পেয়ে সমর্থকদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। চট্টগ্রাম-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মো. হেলাল উদ্দিন। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এসএম ফজলুল হক এবং সাবেক এমপি এবং হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা। মনোনয়নবঞ্চিত এই দুই নেতার এলাকায় রয়েছে প্রচুর জনসমর্থন। মনোনয়ন না পেয়ে সমর্থকদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। চট্টগ্রাম-১২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন এনামুল হক। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক এমপি গাজী শাহজাহান জুয়েল ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি ইদ্রিস মিয়া। বিএনপির দুই হেভিওয়েট প্রার্থী মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় তাদের সমর্থকদের মাঝেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রাম-৭ এবং চট্টগ্রাম-১০ আসনে। এখানে মনোনয়নবঞ্চিতরাও বিএনপির ঘোষিত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লিয়াকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশে দল সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমি মনে করি। আর যদি দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমার প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটা সিদ্ধান্ত নেবো।’
একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম-১৩ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস। তিনি বলেন, ‘এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আমার নাম এক নম্বরে ছিল। গত ১৬ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর জেলে ছিলাম। ১৭টি মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এই মনোনয়নে অসন্তুষ্ট। দল তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করবো।’
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপি বড় দল, এখানে প্রতি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীও বেশি। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে বা দেবে বাকিদের তার পক্ষে কাজ করতে হবে।’
চট্টগ্রামের ছয়টি আসনে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। সেগুলো হলো- চট্টগ্রাম-৩, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-১১, চট্টগ্রাম-১৪ এবং চট্টগ্রাম-১৫। এসব আসনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক।