Image description

বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় নাম রয়েছে দলটির প্রয়াত, সাবেক ও বর্তমান নেতাদের ২৪ জন ছেলে ও মেয়ের। এর মধ্যে ১৯ জন ছেলে, ৫ জন মেয়ে। প্রয়াত দুই নেতার স্ত্রীরাও পেয়েছেন মনোনয়ন। অবশ্য পরিবার অনেকের একমাত্র পরিচয় নয়। এঁদের প্রায় সবাই রাজনীতিতে সক্রিয়।

বিএনপি গত সোমবার জাতীয় সংসদের ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। ৬৩টি আসনে তারা প্রার্থীর নাম এখনো জানায়নি। আলোচনা আছে, শরিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পর বেশ কিছু আসন তাদের দেওয়া হবে। বাকিগুলোতে বিএনপি নিজেদের প্রার্থী দেবে।

সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার কথা আগেই জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী আগেই ২৯৮টি সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম জানিয়েছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শিগগিরই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে পারে।

বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। তাঁর ছেলে ইশরাক হোসেন ঢাকা-৬ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। অবশ্য ইশরাকের ক্ষেত্রে তাঁর বাবার পরিচয়ই একমাত্র নয়। তিনি ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব।

বিএনপি সোমবার যে প্রার্থী তালিকা দিয়েছে, তাতে দলের প্রবীণ নেতাদের যেমন রাখা হয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছেন নবীনেরাও। নতুনদের মধ্যে অনেকে আবার দলের প্রয়াত, সাবেক ও বর্তমান নেতাদের সন্তান।

বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা। তাঁর ছেলে ইশরাক হোসেন ঢাকা-৬ আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। অবশ্য ইশরাকের ক্ষেত্রে তাঁর বাবার পরিচয়ই একমাত্র নয়। তিনি ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব। দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য। কিন্তু রাজনীতিতে নাম লেখানো ও ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে বাবার পরিচয়ই ইশরাকের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার চট্টগ্রামের রাজনীতিতে প্রভাবশালী। চট্টগ্রাম-৭ আসনে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

আন্দোলন সংগ্রামে দীর্ঘদিন থেকে দলের জন্য কাজ করছি। দল যোগ্য মনে করেছে তাই মনোনয়ন দিয়েছে।
মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ আসনে সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে

চট্টগ্রাম-৫ আসনে সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের ছেলে মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনও রয়েছেন বিএনপির মনোনয়ন তালিকায়। হেলাল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক।

মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামে দীর্ঘদিন থেকে দলের জন্য কাজ করছি। দল যোগ্য মনে করেছে তাই মনোনয়ন দিয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিজের সাংগঠনিক যোগ্যতার পাশাপাশি বাবার পরিচয় নির্বাচনে কাজে আসবে।

বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলে নেতাদের সন্তানদের বাবা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের পরিচয়ে রাজনীতিতে আসতে দেখা যায়। পরে তাঁরাই হন নেতা এবং সংসদ সদস্য।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার আগে দেখা যেত দেশের গ্রামগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে গুটিকয়েক পরিবার। পরে জাতীয় রাজনীতিতেও একই চিত্র তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও চর্চা হয় সামন্ততন্ত্রের। ফলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয় না।’

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, কার্যকরভাবে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকলে নেতৃত্বের গুণাবলির পরীক্ষা হতো, প্রতিযোগিতা হতো, আরও দক্ষ ও যোগ্য নেতা তৈরি হতো।

নেতার সন্তানদের মনোনয়ন

ঢাকা-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।

আমরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও চর্চা হয় সামন্ততন্ত্রের। ফলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয় না।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ

গাজীপুর-২ আসনে সাবেক সিটি মেয়র প্রয়াত এম এ মান্নানের ছেলে ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিম রনি, গাজীপুর-৪ আসনে সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহর ছেলে ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ রিয়াজুল হান্নান, মানিকগঞ্জ-২ আসনে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত শামসুল ইসলাম খানের ছেলে ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম খাঁন, ময়মনসিংহ-৯ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আনওয়ারুল হোসেন খান চৌধুরীর ছেলে ও নান্দাইল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইয়াসের খাঁন চৌধুরী, শেরপুর-২ আসনে সাবেক হুইপ প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফাহিম চৌধুরী এবং শেরপুর-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল হকের ছেলে ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহমুদুল হক রুবেল বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।

যশোর-৩ আসনে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক। কুষ্টিয়া-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ চৌধুরীর ছেলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রাগীব রউফ চৌধুরী, ঝিনাইদহ-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের ছেলে ও মহেশপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোহাম্মদ মেহেদী হাসান, সিলেট-১ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত খন্দকার আবদুল মালেকের ছেলে ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মোক্তাদির চৌধুরী এবং পিরোজপুর-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের ছেলে ও ভান্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আহমেদ সোহেল মঞ্জুকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি।

পঞ্চগড়-১ আসনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমির দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। জয়পুরহাট-১ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মোজাহার আলী প্রধানের ছেলে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধান এবং মৌলভীবাজার-৩ আসনে বিএনপির সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমানের ছেলে ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এম নাসের রহমান বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শুধু প্রজন্ম বদলালেই হবে না, রাজনীতির ধরনও বদলাতে হবে।

স্ত্রী-কন্যাদের মধ্যে যাঁরা পেয়েছেন মনোনয়ন

বিএনপি ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন ১০ জন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের বাবা দলের সাবেক অথবা বর্তমান নেতা। তাঁরা হলেন ফরিদপুর-২ আসনে বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খানম রিতা, শেরপুর-১ আসনে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলীর মেয়ে ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সানসিলা জেবরিন এবং নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফারজানা শারমিন পুতুল।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে গুমের শিকার হন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী। তার পর থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর। একপর্যায়ে হন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। এবার তাঁকে সিলেট-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

যশোর-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে যশোর জেলা বিএনপির সাবেক অর্থবিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত নাজমুল ইসলামের স্ত্রী সাবিরা সুলতানাকে। ২০১১ সালে ঢাকায় অপহরণ হওয়ার পর নাজমুলের লাশ মিলেছিল গাজীপুরে। এরপর রাজনীতিতে সক্রিয় হন সাবিরা সুলতানা। তিনি কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য এবং ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও স্থানীয় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।

ঝালকাঠি-২ আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টোকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর স্বামী ছিলেন একই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। তিনি হত্যার শিকার হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ইলেন ২০০০ সালের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন। এরপর তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন।

বিএনপি নেতাদের অনেকেই মনে করেন, দেখতে হবে শুধু মা-বাবার পরিচয়েই মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে, নাকি মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাজনীতিতে সক্রিয়? যোগ্যতা, দক্ষতা, সক্ষমতা, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলে যে কেউ রাজনীতিতে আসতেই পারে।

আরও অনেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন

বাবা বা স্বামীর হাত ধরে রাজনীতিতে এসে বিএনপির কাছে সংসদ সদস্যের টিকিট চেয়েছিলেন, এমন সংখ্যা অর্ধশতের বেশি। কারণ, বিএনপি এবার ঠিক করেছে, একই পরিবার থেকে একাধিক জনকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। যেমন ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও তাঁর পুত্রবধূ নিপুন রায় চৌধুরী দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এই আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে। এমন উদাহরণ আরও আছে।

বিএনপি যে ৬৩টি আসনে এখনো সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি, সেখানে ৯টি আসনেও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় দলের নেতাদের পুত্র ও কন্যা রয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শুধু প্রজন্ম বদলালেই হবে না, রাজনীতির ধরনও বদলাতে হবে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিতে আসার ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকলে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। প্রশ্ন উঠে যখন রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে পারিবারিক পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে এবং নিজের পরিচয় গড়ে তোলার আগে পরিবারের পরিচয় ব্যবহার করে কেউ রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে।

মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকা ও উত্তরাধিকার বিবেচনা করায় দল, দলের রাজনীতির পাশাপাশি জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন হাসনাত কাইয়ূম। তিনি বলেন, নেতাদের সন্তান কিংবা তাঁর পছন্দের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার মাধ্যমে যাঁরা দলের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন, ঝুঁকি নিয়েছেন, তাঁদের রাজনীতি থেকে বের করে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়াও চালু হয়। এর ফলে রাজনীতিতে একধরনের অসুস্থ প্রবণতা তৈরি হয়।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার প্রতিনিধিরা]