বিগত বছরে দলের সিনিয়র নেতারা যখনই কারাগারে গেছেন, একজনের বিশেষ যত্ন পেতেন নিয়ম করেই। সেই সুবাদে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এক দল ক্ষমতাহীন হওয়ার বছর না পেরোলেও আবারও ‘ক্ষমতার’ বলয়ের মধ্যেই রয়েছেন তিনি। জেলখানায় নেতাদের বিশেষ সেবাযত্ন করার ‘উপহার’ হিসেবে তরুণ এই ব্যক্তি পেয়েছেন মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সদস্য সচিবের পদ।
সদ্য বিগত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মৌলভীবাজার জেলা আহ্বায়ক ফয়জুর রহমান ময়ুনকে লেখা চিঠিতে জানান, ‘আব্দুর রহিম রিপনকে সদস্য সচিব এবং সুনীল কুমার, শ্যামলী সুত্রধর ও রহমান মজনুকে সদস্য হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে নির্দেশক্রমে মনোনীত করা হয়েছে।’
রুহুল কবির রিজভীর এই চিঠির পর মৌলভীবাজার জেলার নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ হয়ে জেলার জ্যেষ্ঠ ১৯ জন নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো চিঠিতে রিপনের পদপ্রাপ্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বিক্ষুব্ধ নেতাদের চিঠিতে বলা হয়, ‘আব্দুর রহিম রিপন ওয়ান-ইলেভেনের (অন্যতম কুশীলব) ব্রিগেডিয়ার বারী এবং আমিনের সঙ্গে সম্পর্ক করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ব্রিগেডিয়ার বারীর মাধ্যমে তৎকালীন আইজি প্রিজন সৈয়দ ইফতেকার উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং ইফতেকার উদ্দিন সাহেবের প্রধান ক্যাশিয়ার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। তার মাধ্যমে দেশের সব কারাগারের বদলি বাণিজ্য করে অর্থ-সম্পদ কামাই করে।’
‘বিএনপির হেভিওয়েট নেতারা যখন কারান্তরিত হন, তখন সে তাদের কাছ থেকে আর্থিক ও নানাবিধ সুবিধা নিয়ে তাদের আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন পাত্রে পরিণত হয়।’
চিঠিতে বিএনপির নেতারা উল্লেখ করেছেন, ‘আব্দুর রহিম রিপনকে সদস্য সচিব করায় জেলা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।’
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিঠি কাকে দেওয়া হয়েছে।’
জবাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া হয়েছে জানানো হলে জি কে গউছ বলেন, ‘তাহলে এটা উনিই (তারেক রহমান) দেখবেন। দলের কোনও কমপ্লিন থাকলে দেখবেন দলের অভিভাবক, তারেক রহমান আমাদের দলের অভিভাবক।’
জি কে গউছ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী আছে। কারও ব্যক্তিগত ত্রুটি তার নিজস্ব, নিজের। কিন্তু দল করতে হয় সবাইকে নিয়ে। যারা আন্দোলনে ছিল, সংগ্রামে ছিল, তাদের ভূমিকা কেউ চাইলেই ঢেকে রাখতে পারবে না। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তৃণমূলের খবর রাখেন। তার কাছে তৃণমূলের তথ্য রয়েছে, মাঠ পর্যায়ের তথ্য রয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সদ্য মনোনীত সদস্য সচিব আব্দুর রহিম রিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ২০১০ সালে জেলা বিএনপির কমিটিতে ছিলাম। আমি পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমি জেলা বিএনপির শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছি। এরপর আমি জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসের রহমান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের সুপারিশেসহ সাধারণ সম্পাদক হলাম। পরে জেলা কমিটির সুপার ফাইভে এসেছি।’
কিন্তু সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানও রয়েছেন অভিযোগকারীদের মধ্যে, এ প্রসঙ্গে আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমি তো মিজানুর রহমানসহ আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সুপার ফাইভের কমিটিতে উনি ছিলেন চার নম্বরে, আমি পাঁচে। আপনার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।’
অভিযোগের মধ্যে বিগত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুর রহিমের উত্তর, ‘ছবি থাকতেই পারে। আমি আওয়ামী লীগের কোনও প্ল্যাটফরমে কোনও কিছুতে নেই। আমরা তারেক রহমানসহ যখন বৈঠক করেছি, তখন তো ওই অভিযোগ আসেনি। আসলে পদ-পদবির কারণেই এখন এসব বিষয় আলোচনায় রয়েছে। আমরা নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কাজ করতে চাই। এ ধরনের বিষয় মূলত ব্যক্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
পরে আব্দুর রহিম রিপনের পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আহ্বায়ক কমিটিতে আমি তাকে (আব্দুর রহিম রিপন) মনোনীত করিনি। তিনি আগের কমিটির শিল্প-বাণিজ্য সম্পাদক ছিলেন।’
‘আহ্বায়ক কমিটিতে কীভাবে সদস্য হয়েছেন আমি তা জানি না। তবে তিনি সদস্য সচিব মনোনীত হওয়ার পর আমরা কমিটির ৩২-৩৩ জনের মধ্যে ১৯ জনই চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি তো রাজনৈতিক, ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো। কিন্তু রাজনৈতিক কাজ, দলের দিক থেকে বিবেচনা করলে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপি লজ্জিত, বিব্রত। আমরা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেবকে লিখিতভাবে দিয়েছি। উনি সিদ্ধান্ত নেবেন।’ বলেন মিজানুর রহমান।
সিলেট বিভাগ ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপকালে জানা গেছে, বিগত সরকারের সময়ে বিএনপির সিনিয়র নেতারা যখনই জেলে গেছেন, সেখানে নানা ধরনের সুবিধা ও সৌজন্য বিনিময়ের প্রাপ্তি হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সদস্য সচিবের পদ পেয়েছেন আব্দুর রহিম রিপন। বয়সে তরুণ এই ব্যক্তি জেলখানায় দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে সহযোগিতা করেছেন।
বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদক একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপ করে বিষয়টির সত্যতা জেনেছেন। গত সোমবার (১৩ জানুয়ারি) দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি আব্দুর রহিমকে চেনেন। জেলখানায় সহযোগিতা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
‘সদস্য সচিবের’ পদপ্রাপ্তিতে কারাগারে সিনিয়র নেতাদের পাশে থাকা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানান জেলা বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা। এক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটির তিন জন সদস্য, একজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতা রয়েছেন বলে সিনিয়র এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।
কয়েক দিন আগে দেওয়া তারেক রহমানকে চিঠিতে বিএনপির ১৯ জেলা নেতা অভিযোগ করেন, ‘বিগত ৩১-১২-২০২৪ইং মঙ্গলবার অবগত হই যে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সদস্য সচিব হিসেবে আব্দুর রহিম রিপনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, আব্দুর রহিম রিপন তার রাজনৈতিক জীবনে অতীতে ছাত্রদল, যুবদল ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। স্কুলজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা কামাল গ্রুপের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।’
‘১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি যখন রাজপথে আন্দোলনরত ছিল, এই আব্দুর রহিম রিপন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে চৌমুহনা চত্বরে বিএনপির মিছিলের ওপর আক্রমণ করে। বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফয়জুল করিম ময়ূন আক্রমণের শিকার হন। জেলা বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী বিষয়টি অবগত রয়েছেন।’
চিঠিতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে রিপনের ছবির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এও বলা হয়, ‘আওয়ামী নেতাদের আনুকূল্যে ব্যবসায়িক সুবিধা নিয়ে সে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছে।’
চিঠিতে আব্দুর রহিম রিপনকে ‘বিতর্কিত ব্যক্তি’ উল্লেখ করে তাকে অপসারণের অনুরোধ করেন ১৯ জন নেতা।
চিঠিতে আবেদ রাজা, মোশাররফ হোসেন বাদশা, মিজানুর রহমান, মতিন বক্স, মহিতুর রহমান হেলাল, মাহমুদুর রহমান, বকসী জুবায়ের আহমেদ, আবুল কালাম বেলাল, স্বাগত কিশোর দাশ চৌধুরী, মাহবুব ইজদানী ইমরান, মনোয়ার আহমদ রহমান, গাজী মারুফ আহমদ, আনিছুজ্জামান বায়েছ, সেলিম মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আব্দুল হক, আশরাফুজ্জামান খান নাহাজ, আসিক মোসাররফ, মো. হেলু মিয়া ও জিতু মিয়ার নাম রয়েছে।
এই চিঠি দেওয়া হয়েছে বিএনপির মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদেরও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএনপির প্রয়াত এক প্রভাবশালী নেতার ছেলের সংস্পর্শে থাকেন রিপন। তার শক্তিবলেই পদ পেয়েছেন রিপন।’
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফয়জুল করিম ময়ূনকে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অভিযোগের পর দলীয়ভাবে কোনও অগ্রগতি হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে অভিযোগকারীদের একজন মতিন বক্স বলেন, ‘আমরা লিখিত অভিযোগ দলের মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের কাছেও অভিযোগ সাবমিট করেছি।’
মতিন বক্স জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকসহ জেলার যুবদল, ছাত্রদলের বিভিন্ন পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।