ভারতের নাচের পুতুল শেখ হাসিনা পালানোর পর এক বছর পার হতে না হতেই ভয়াবহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশ। একদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে নির্বাচন ইস্যুতে মতভেদ। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট-নাকি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট, তা নিয়ে চলছে চাপানউতোন। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হলে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে। গণভোটের তফসিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তা আদালতে গড়াবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে দু’মাসের মধ্যে দু’টি বৃহৎ নির্বাচন হলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটবে। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গত শুক্রবারও বলেছেন, ‘যেটাই ঘটুক ১৫ ফেব্রুয়ারির আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠত হবে।’ আবার নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট প্রস্তাব করলেও জামায়াত চাচ্ছে সবার আগে গণভোট দিতে হবে। দলটির এক নেতার ভাষায় ‘জাতীয় নির্বাচন হোক না হোক গণভোট দিতে হবে’। জামায়াতের নেতৃত্বে আটটি দলের সমন্বয়ে জোট গঠন করে আন্দোলনে নেমেছে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ‘গণভোট আগে হবে-নাকি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সিদ্ধান্ত দেবেন।’ এখন ড. ইউনূস কী সিদ্ধান্ত দেন সেটি দেখার জন্য দেশবাসী মুখিয়ে রয়েছে। তবে এরই মধ্যে অনেকে বলছে শুরু করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যত এনসিপি ও জামায়াত প্রভাবিত। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ছিলেন আবার ওই কমিশন প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ নিজেই গ্রহণ করেছেন। মূল সনদ থেকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দেয়ার অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। অথচ বিএনপির দাবি সত্য-নাকি মিথ্যা এ নিয়ে মুখ খুলছে না কমিশন। এ যেন এক চরম অনিশ্চয়তা! ১২ কোটি ভোটার যখন জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে; তখন হঠাৎ করেই যেন রাজনৈতিক গভীর সংকটে পড়ে গেল দেশ। এই রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামায়াত জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করলেও সবার আগে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলটি এখন নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি ছয়টি ইসলামীসহ আটটি দলের সমন্বয়ে জোট গঠন করে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করছে। শুধু তাই নয়, দেশের সব আকিদার ইসলামী দল, মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভোট নিজেদের পক্ষে নিতে মহাপরিকল্পা করে মাঠে নেমেছে। আসন্ন নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গী হতে ইসলামী ধারার দলগুলো যা চাইবেÑ জামায়াত তাই দিতে রাজি। উদ্দেশ্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।
এমনকি দলটি দেশি সব দল, শক্তি, গোত্র ছাড়াও বিদেশি শক্তিগুলোকেও নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টায় মরিয়া। জামায়াতের এমন ‘ব্লাঙ্ক চেক’ সামনে ঝুলালেও ইসলামী ধারার কয়েকটি দল তা গ্রহণ না করে বিএনপির প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। এমন যখন অবস্থা তখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল বিএনপি কী করছে? আসন্ন নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে কি বিএনপিই আলেমদের ভোটের প্রয়োজন নেই?
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টিার যুগ্ম মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এদেশের ইসলামপন্থী আলেম-ওলামাদের সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক রাখতেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া আলেম-ওলামাদের কোনো দিন অবজ্ঞার চোখে দেখেননি। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মুফতি আমিনীসহ দেশবরেণ্য আলেম-ওলামাদেরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। বেগম খালেদা জিয়া আলেম ওলামাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। জামায়াতে ইসলাম আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ইসলামী দলগুলোর সাথে ঐক্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপি পিছিয়ে আছে। ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবিলা এবং ইসলামী মূল্যবোধের সরকার গঠনের লক্ষ্যে ইসলামী দলগুলোর সাথে বিএনপির ঐক্য গড়া সময়ের অপরিহার্যতা।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, প্রায় ২০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত। নভেম্বরের প্রথম দিকে সে তালিকা প্রকাশ করা হবে। শুধু তাই নয়, বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ-বিরোধী আন্দোলন যে সব দল বিএনপির সঙ্গী হয়ে মাঠে ছিল সেসব দলকে কিছু আসন ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জনসমর্থনহীন ছোট দলের বড় কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে। বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ধারার পাঁচটি এবং জাগপা নামের একটি দল নমিনেশন নিশ্চিত না হওয়ায় জামায়াতের জোটে চলে গেছে। বিএনপি মূল্যায়ন করবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে যে সব ইসলামী দল জামায়াতের ডাকে সাড়া দেয়নি এবং প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে; সেসব দল কী আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গী হচ্ছে? ওই দলগুলোকে সঙ্গী করতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে? নাকি ওই দলগুলো শেষ পর্যন্ত জামায়াতের জোটসঙ্গী হয়ে নির্বাচন যুদ্ধে নামবে? এমন হাজারো প্রশ্ন এবং শঙ্কা বিএনপি অনুসারী বুদ্ধিজীবী, তৌহিদি জনতা এবং ইসলামী দলগুলোর কর্মী সমর্থকদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা নিজেদের এই শঙ্কা নানাভাবে প্রকাশ করছেন। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছর বিএনপির সঙ্গে মাঠে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এমন ইসলামী ধারার দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জামায়াত অর্ধশত আসনে তাদের প্রার্থী করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বিএনপি এখনো কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। কিছুদিন আগে বিএনপির একাধিক নেতা হেফাজতসহ ইসলামী দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও এখন যোগাযোগ রাখছেন না। এমনকি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের হাবভাব এমন যে, ইসলামী দলগুলো নির্বাচনী যুদ্ধে বিএনপির সঙ্গে না এসে যাবে কোথায়? প্রশ্ন হচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে কারা থাকছেন? বিএনপি কী ইসলামী দলগুলোকে নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দিকে ঠেলে দিয়ে ভোটযুদ্ধে নামবে; নাকি আলেম-ওলামা-পীর-মাশায়েখের জাকেরান-আশেকান ও মাজার-দরগার অনুসারী লাখ লাখ ভোট একচেটিয়াভাবে নিতে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট করবে?
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের মন জোয়ার-ভাটার মতোই। মানুষের মন কখন কার দিকে ছুটে বলা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর কোন দলের পক্ষে কখন জোয়ার ওঠে; আর কখন ভাটার টান পড়ে সেটিও বলা সম্ভব নয়। কয়েক বছর আগেও দেশের আকাশ-বাতাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর শেখ হাসিনার নাম ধ্বনিত হয়েছে। হাটে-মাঠে-ঘাটে শুধুই মুজিব আর হাসিনা বন্দনা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে; অথচ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কোনো খবর না রেখে পাকিস্তানের কারাগারে ভোগ-বিলাসে কাটানো শেখ মুজিব একাই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন, এমন ইতিহাস রচনা হয়েছে। সেই শেখ মুজিবের মূর্তি এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে; হাসিনা পালিয়ে গেছে দাদাদের দেশে। এসবই ঘটেছে কর্মদোষে। বর্তমানে সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বিএনপির সমপর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। দলটির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধকে কার্পেটের নিচে চাপা দেয়ার চেষ্টারত জামায়াত। জনসমর্থন তেমন না থাকলেও সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত দলটি নির্বাচনে বিজয়ী হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিএনপির চেয়ে জনসমর্থনে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকা দলটিকে তুচ্ছজ্ঞান করছে। বাস্তবতা হলোÑ খেলার মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা আত্মঘাতী। তার প্রমাণ মিলেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সাংগঠনিকভাবে পাহাড়সম শক্তিশালী বিএনপি যা পারেনি জামায়াত ক্ষুদ্্র জনসমর্থন নিয়ে প্রশাসনযন্ত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রমাণ করেছে ‘ছোটকে কখনো ছোট বলতে নেই’। জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘গণভোট’ দাবিতে মাঠের আন্দোলনে থাকলেও জামায়াত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপক প্রস্তুতি দিয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী হতে যাকে যেভাবে ম্যানেজ করা দরকার দলটি করছে। এমনকি চিন্তা-চেতনা ও আকিদায় বিপরীতমুখী ইসলামী কয়েকটি দলকে নির্বাচনী জোটে নিয়েছে। মাঠে এখন জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট পার্টি। এই দলগুলোর মধ্যে ডেভলপমেন্ট পার্টি শেখ হাসিনার অনুকম্পায় নিবন্ধন পেলেও জাগপাসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলো কখনোই জামায়াতের মওদুদীবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল না এবং জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। অথচ বিএনপির দায়িত্বশীল কিছু নেতার ‘নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় যাবে অন্যকে ভাগ দেবো কেন’ এমন অতি আত্মবিশ্বাসই এই ইসলামী দলগুলো জামায়াতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ নব্বইয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনের চিত্র দেখলে দেখা যায়, এসব দল সবসময় বিএনপির পাশে ছিল। হিন্দুত্ববাদী ও ভারতমুখী রাজনীতির কারণে এই দলগুলো আওয়ামী লীগ-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় দলগুলোর নেতা আলেম-ওলামাদের উপর জুলুম-নির্যাতন করেছে হাসিনা গং। পাতানো আদালতে নিজামী, কাদের মোল্লা, মুজাহিদদের ফাঁসি দেয়ার পর জামায়াত কার্যত গর্তে লুকিয়েছিল। তখন এই ইসলামী দলগুলো বিএনপি মতোই মাঠে আন্দোলন করেছে। গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর ঠেকাতে এই দলগুলোর নেতা ও অনুসারীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলায় তাদের অনেকে বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। বিএনপির কিছু নেতার অপরিণামদর্শী মানসিকতা ও অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে ইসলামী দলগুলোকে আসন্ন নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মসজিদকেন্দ্রিক। পাড়া-মহল্লার মসজিদের ইমামদের মান্য করেন এলাকাবাসী। ফলে প্রতিটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম তথা আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে দেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনে ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল, মসজিদ, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, আলেম-ওলাদাম-পীর-মাশায়েখরা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা খুবই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ফলে যে সব দল পাওয়ার পলিটিক্স করে তারা নির্বাচনে ভোট টানতেই আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা-পীর-মাশায়েখদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় থেকে এ ধারা চলে আসছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাস্তবতায় রাজনীতি ও নির্বাচনী কৌশল নিতেন। এবার বিএনপি কী সে কৌশল থেকে অনেক দূর সরে যাচ্ছে?
জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদকে। তার নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিরা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি (আশরাফ), হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, জমিইয়াতে হিজুল্লাহ বাংলাদেশের আমিরসহ কয়েকটি ইসলামী দল ও ইসলামী স্কলারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব দল ও পীর সাহেবদের বিপুল সংখ্যা আশেকান মুরিদান আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশালী এই মুরিদানরা যুগের পর যুগ ধরে বিএনপির প্রার্থীদের ভোট দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু ওই দেখা সাক্ষাতের পর বিএনপির নেতারা আর ইসলামী দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখছেন না। ফলে জামায়াত ওই সব ইসলামী দলের কয়েকটিকে নিজেদের জোটে নিতে সক্ষম হয়। জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছেন এমন একজন নেতা জানান, আমরা আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু বিএনপি নেতাদের মানসিকতা নির্বাচন হলেই তারা ৩০০ আসনে জিতবে। ফলে ইসলামী দলগুলো সমর্থনের প্রয়োজন পড়বে না; তাই আসন দিতে চায় না। তাছাড়া বিএনপি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার ভাবখানা এমনÑ আলেম-ওলামারা বিএনপির বাইরে যেতে পারবে না। এ কারণে বিএনপিকে ইসলামী দলগুলো বিএনপির অঙ্গ সংগঠন নয়, বুঝিয়ে দিতেই জামায়াতের জোটে আসতে বাধ্য হয়েছি।
সূত্র জানায়, বিএনপির বিগত আন্দোলনে সঙ্গে ছিল এবং যুগপৎ আন্দোলন করেছে এমন দলগুলোর কয়েকজন নেতাকে মনোনয়ন দিচ্ছে। এদের মধ্যে মাহমুদুর রহমান মান্না, তানিয়া রব (আ স ম রব অসুস্থ), নুরুল হক নূর, রাশেদ খান, আন্দালিব রহমান পার্থ, ববি হাজ্জাজসহ কয়েক জনকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে। এসব নেতার নিজস্ব তেমন ভোট নেই। প্রার্থী করা হলে এদের বিজয়ী করে আনতে বিএনপিকে কাজ করতে হবে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে ব্যাপক ভোট রয়েছেন এমন ইসলামী দলগুলোর নেতা যেমনÑ সিলেটে মাওলানা ওবায়দুল ফারুক, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, নারায়ণগঞ্জের মাওলানা মুফতি মনির হুসেই কাসেমী, নিলফামারির মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, চট্টগ্রামের পটিয়ার মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ফটিকছড়ির মাওলানা শেখ শাহজাহান, ঢাকার মাওলানা মামুনুল হক, মাদারিপুরের মাওলানা জালালউদ্দিন আহমদ, ফরিদপুরের মাওলানা মুফতি শরাফত হোসাইন, কুমিল্লার মাওলানা মুফতি সাখাওয়াত রাজীর মতো আলেমদের গ্রিন সিগন্যাল দিলে সারা দেশের আলেম-ওলামা-মথায়েখ, পীর-দরগা-মাজারের অনুসারী এবং মাদরাসা ও কওমি মাদরাসা-ভিত্তিক ভোটাররা বিএনপির পক্ষে চলে আসবে। তখন জামায়াতের সঙ্গে যারা গেছেন তাদের কেউ কেউ বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামতে বাধ্য হবেন। অথচ ইসলামী দলগুলোকে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনী মাঠে নামানোর বদলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধিদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক নেতা জানান, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের কথাবার্তার মূল বার্তা হলোÑ নির্বাচন হলেই ৩০০ আসনে বিএনপি বিজয়ী হবে। তাহলে ইসলামী দলগুলোকে নিজেদের (বিএনপি) আসন ছেড়ে দেবো কেন? বাস্তবতা কী বলে? এই নেতা কী বিএনপি থেকে ইসলামী দলগুলোকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছেন? গতকালও সালাহউদ্দিন আহমদ নারায়ণগঞ্জে বলেছেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন এলেই ধর্মকে ব্যবহারের চেষ্টা দেখা যায়।’ ৯২ শতাংশ মুসলমাদের দেশে নির্বাচন এবং রাজনীতি ধর্মের ব্যবহার তো হবেই। ইসলামবিদ্বেষী শেখ হাসিনা নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার কম করেছেন? বিএনপির নেতার মুখে এমন বক্তব্য কি শোভনীয়? অবশ্য বিএনপির এই নেতা এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে হাসিনার অলিগার্ক এস আলম (সাইফুল আলম) সম্পদ রক্ষার অভিযোগ উঠেছে। তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরেই প্রথম এলাকায় গেছেন এস আলমের দেয়া গাড়ি-বহরে। অবশ্য সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে প্রথম মুখ খোলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গত জুলাই মাসে। কক্সবাজার শহরে এক সমাবেশে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আগে নারায়ণগঞ্জে বিখ্যাত গডফাদার শামীম ওসমান ছিল। এখন শুনছি কক্সবাজারের নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে, মানুষের জায়গা-জমি দখল করছে, চাঁদাবাজি দখল করছে। আবার নাকি সে সংস্কার বোঝে না। নাম না বললাম। কক্সবাজারের জনতা এ ধরনের সংস্কারবিরোধী, যে পিআর বুঝে না রাজপথে তাদেরকে দেখিয়ে দেবে, ইনশাআল্লাহ।’ এনসিপি নেতা সেদিন কারো নাম উল্লেখ না করলেও বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে এ বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এখন বিএনপির অনেক নেতাই বলছেন, বিএনপির দুর্দিনে যেসব নেতা দেশে ছিলেন না তাদের অনেকেই এখন হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। তারাই কি বিএনপির নির্বাচনী কর্মকৌশল ঠিক করার নামে ইসলামী দলগুলোকে বিএনপি থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতকে শক্তিশালী করছেন? বিএনপির নিজস্ব ভোটার হিসেবে চিহ্নিত ইসলামী দল এবং আলেম-ওলামা-মাশায়েখ-পীর-খানকা-দরগার কর্তাব্যক্তি ও ভোটারদেরকে জামায়াতে দিকে ঠেলে দেয়ার নেপথ্যে কি কোনো নীল নকশা রয়েছে? যুগের পর যুগ ধরে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভোটারদের দূরে ঠেলে দিয়ে বিএনপি কাদের সঙ্গে নিয়ে ভোটযুদ্ধে নামতে যাচ্ছে?