রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে বিএনপির টিকিট পেতে নেতারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। প্রায়ই ঘটছে হানাহানি-মারামারি। এতে দুই কর্মীর প্রাণ গেছে। এ ছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ির কারণে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছে। সবমিলে নির্বাচন সামনে রেখে এই আসনে বিপর্যস্ত বিএনপি। এর বিপরীতে জামায়াত সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
বরাবরই এ আসনটিতে বিএনপির একক আধিপত্য। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এখানে এমপি নির্বাচিত হন সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক। ২০১৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এবার এখানে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসাবে তার ভাই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীনসহ অন্তত আটজন মাঠে আছে। অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন-আমিনুল হকের ফুফাতো বোনের ছেলে ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন, শিল্পপতি সুলতানুল ইসলাম তারেক, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব বিশ্বনাথ সরকার, জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় সহকারী মহাসচিব আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বিপ্লব, মহানগর বিএনপির সাবেক নেতা কেএম জুয়েল, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শাহাদাত হোসেন শাহীন। এ ছাড়া ব্যারিস্টার আমিনুল হকের স্ত্রী আভা হকের নামও আলোচনায় এসেছে। তবে এসব মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর শুধুমাত্র মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীন, ব্যারিস্টার মাহফজুর রহমান মিলন এবং সুলতানুল ইসলাম তারেককে গুলশান কার্যালয়ে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়।
দুইবারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক ২০০৮ সালে প্রার্থী হতে পারেননি। আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন আমিনুল হকের ভাই সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক। পরের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনেও এমপি হন ফারুক।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আসনটি আবারও ফিরে পেতে চান বিএনপির নেতাকর্মীরা। অভ্যুত্থানের আগে দু-একজন নেতা মাঠে থাকলেও পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনোনয়ন পেতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আর এ কারণেই দেখা দেয় সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল আর উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। জাড়িয়েছেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী শরীফ উদ্দিন এবং সুলতানুল ইসলাম তারেকের সমর্থকরা একের পর এক সংঘাতে জড়াচ্ছেন। এ ছাড়া শরীফ উদ্দীনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গত ১১ মার্চ তানোরে বিএনপির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসাবে শরীফ উদ্দীনকে বরণ করা নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে গানিউল ইসলাম নামে একজন নিহত হন। এর কয়েক দিন পর ২৭ মার্চ তানোরে একই মনোনয়নপ্রত্যাশীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে কৃষক দল নেতা নেকশার আলী নিহত হন।
এ ছাড়া তানোর উপজেলা সদরে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর তারেকের সমর্থকদের সঙ্গে শরীফ উদ্দীনের অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। ৪ জানুয়ারি ভবানীপুরে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষে গোদাগাড়ীর বারোমাইল এলাকায় তারেকের অনুসারী কয়েকজন নেতা আহত হন। সবশেষ ২ সেপ্টেম্বর দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গোদাগাড়ীতে একই স্থানে উভয়পক্ষের সমাবেশ আহ্বানকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। এ সময় শরীফ উদ্দীনের অনুসারী বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন নেতা আহত হন। এসব ঘটনায় পালটাপালটি মামলাও হয়েছে।
নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং এ আসনটিতে ভোটকেন্দ্রিক বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দীন বলেন, ‘মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ২০ জন থাকতে পারে। এটি কোনো সমস্যা না। গুলশান কার্যালয়ে মাত্র তিনজনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। আমার পক্ষ থেকে কোনো গ্রুপিং নেই। সবাই ধানের শীষের সমর্থক। দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করলে সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন।’
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনৈক্যের কারণে জামায়াত লাভবান হবে কিনা এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার বিষয়ে সুলতানুল ইসলাম তারেক বলেন, ‘বিএনপি বড় দল। এখানে প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা রয়েছে-আমরা যেন সংঘাতে না জড়াই। আমরা এ ব্যাপারে সবসময় সতর্ক রয়েছি।’
তিনি বলেন, মনোয়নন যখন চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হবে, ‘তখন পরিস্থিতি পালটে যাবে। সবাই দলের প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। আর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জনসমর্থনের বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ভোটের ফলাফলেই তা প্রমাণিত হবে। অনেক কথা হয়তো আসছে। তবে শেষ পর্যন্ত এ আসনে বিএনপি প্রার্থী জামায়াতের বিরুদ্ধে এক-তৃতীয়াংশ বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হবেন।’
এদিকে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাইরে নিজের মতো করে ভোটের মাঠে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও উপজেলা বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন। তিনি বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে যিনি কাজ করেছেন, নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন এবং এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন-এমন ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত। দলের মনোনয়ন বোর্ড এসব বিষয়ে অবগত। এসব বিবেচনায় নিয়েই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
অপরদিকে বিএনপির মধ্যে বিভাজন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে জামায়াত নেতাকর্মীরা জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। ১৯৮৬ সালে সারা দেশে জামায়াত ১০টি আসনে জয়লাভ করে। এর মধ্যে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে দলীয় প্রতীকে বিজয়ী হন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনেও দল তাকেই প্রার্থী করেছে। দীর্ঘ সময় থেকেই তিনি জোরেশোরে ভোটের মাঠে রয়েছেন। নেতাকর্মীদের নিয়ে নির্বাচনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন, বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। একক প্রার্থী হওয়ায় পুরো দল পূর্ণশক্তি নিয়ে তার হয়ে কাজ করছে।
রাজশাহী জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আব্দুল খালেক বলেন, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গোদাগাড়ী-তানোরের মানুষের কাছে একজন সৎ, যোগ্য এবং আদর্শবান মানুষ হিসাবে পরিচিত। তিনি মেধাবী ব্যক্তি। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দের তালিকায় মুজিবুর রহমানকে শীর্ষে রাখবেন।