Image description
 

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য ছিল, এখন তা নেই বললেই চলে বরং অনৈক্য প্রকাশ্য চলে এসেছে। ফলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। এছাড়া অনেক রাজনীতিক আশঙ্কা করছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না

 

ফের জটিল সমীকরণে দেশের রাজনীতি। বিশেষ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম মতবিরোধ। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সুপারিশে লিপিবদ্ধ না করা এবং গণভোটের সময় নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে বিরোধ প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাছাড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস কোন ক্ষমতা বলে দেবেন, তা নিয়েও বিএনপিসহ কয়েকটি দল প্রশ্ন তুলেছে। কমিশনের সুপারিশমালায় অনেক জায়গায় অস্পষ্টতা রয়েছে উল্লেখ করে তা সংশোধন করারও আহ্বান জানিয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের সমালোচনায় ব্যস্ত। বলা যায়, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য ছিল, এখন তা নেই বললেই চলে বরং অনৈক্য প্রকাশ্য চলে এসেছে। ফলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন মহল। এছাড়া অনেক রাজনীতিক আশঙ্কা করছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা পেশ করে। এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, ঐকমত্য কমিশন ঐক্য সৃষ্টির বদলে জাতীয় অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ, জুলাই সনদের যে খসড়ায় বিএনপি স্বাক্ষর করেছিল সেখানে অনেক বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছিল অথচ সুপারিশমালায় সেগুলো রাখা হয়নি। আরও অনেক দফা যোগ করা হয়েছে যেগুলো আলোচনার টেবিলেই ছিল না।

প্রায় একই ধরণের অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। যে কোনো আদেশ অবশ্যই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত হতে হবে। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশে জাতির কাছে স্পষ্ট হয়েছে, বছরব্যাপী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থ ও সময়ের অপচয় প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ। সেখানেই এই সনদের আইনি ভিত্তি রচিত হবে। অথচ কমিশনের সুপারিশমালায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পরিষদ নামে একটি টার্ম যোগ করা হয়েছে। এটা অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যমূলক। তবে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ জানিয়ে ফখরুল বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সঙ্গে সংসদ নির্বাচনের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে। তার আগে গণভোট অনুষ্ঠিত করার কোন সুযোগ নেই।

এদিকে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে জামায়াত ইসলামী বেশ খুশি। দলটি এখন গণভোটের দাবিতে সোচ্চার। যদিও সমমনা কয়েকটি দল নিয়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে কিছুদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করছে দলটি। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনে আপত্তি না থাকলেও জামায়াতের এখন প্রধান দাবি নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে।

রাজধানীর মগবাজারের আলফালাহ মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আজ (৩০ অক্টোবর) রাত অথবা আগামীকালের মধ্যে গণভোটের আদেশ জারি করতে হবে। না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণ আস্থা হারাবে। তাহের বলেন, আমরাও ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন চাই। তার আগে কমিশন যে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, সেটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দিতে হবে।

অপরদিকে, বিএনপি আগেই জানিয়েছে, গণভোট হতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৩ মাস বাকী। এমন অবস্থায় আগে গণভোট অনুষ্ঠিত করা ঝামেলাপূর্ণ, ব্যয়বহূল। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মনে ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। জাতীয় নির্বাচন বানচাল হতে পারে অথবা পিছিয়ে যেতে পারে এমন কোন কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না বিএনপি।

সনদে স্বাক্ষর না করা এনসিপির দাবি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করা এবং সেটা প্রধান উপদেষ্টাকেই করতে হবে। দলের মূখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটওয়ারি বলেছেন, গণভোট যে কোন সময় অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সেটা হতে হবে স্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য। পাটওয়ারি আরও জানান, ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী আদেশ জারির বাস্তবায়ন দেখতে চায় এনসিপি।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা নিয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন,
অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশে সংবিধান সংস্কার হলে তা টেকসই হবে না। তাছাড়া ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন অনিশ্চিত এবং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের পদত্যাগও করা লাগতে পারে। মঞ্জু আশা প্রকাশ করে বলেন, সরকার চূড়ান্তভাবে যখন গণভোট আয়োজন করবে তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে।

জাতীয় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি জানিয়েছেন, কোন ক্ষমতাবলে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জারির আদেশ দেবেন। রাষ্ট্রের নিয়ম হচ্ছে, আদেশ জারির নির্দেশ দেবে সরকার, যেটা রাষ্ট্রপতির নামে যায়। প্রধান উপদেষ্টা আদেশ জারির অর্থ, তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন, এতে সংবিধানকে স্থগিত করা হয়ে যায়। তাছাড়া ঐকমত্য ছাড়া কেউ কারও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তা কার্যকর হবে না।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন বিলুপ্তির পথে। ভিন্নমত এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দলগুলোর অনৈক্য এখন দৃশ্যমান। সেই সঙ্গে সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারক মহলের বক্তব্য ও মন্তব্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। প্রতিনিয়ত বিপরীতমুখী বক্তব্যের কারণে সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।

শীর্ষনিউজ