Image description
 

গত বছর গণ–অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ বুধবার একযোগে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট। সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়েছে ই–মেইলে।

সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যায় তাঁর দায়, আসন্ন নির্বাচন, দেশে ফেরা, ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এগুলোই পলাতক জীবনে তাঁর দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার।

তিনটি সাক্ষাৎকারেই শেখ হাসিনা একই ভাষায় কথা বলেছেন। নিজে কোনো কিছুর দায় নেননি, কোনো কিছুর জন্যই অনুশোচনা করেননি। ছাত্র-জনতার হত্যার জন্য মাঠপর্যায়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়ী করেছেন। এমনকি তাঁর ভাষায়, সহিংস বিদ্রোহ দমনকে সাংবিধানিক অধিকার বলেও বর্ণনা করেছেন।

আবার নিজে পরপর তিনটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করলেও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চেয়েছেন। নিজে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে বিভেদ বাড়ালেও এখন বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে দেশে বিভেদ বাড়বে।

ক্ষমা চাইতে অস্বীকার

দ্য ইনডিপেনডেন্ট তাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনে বলেছে, ১৫ বছরের বেশি সময় কঠোরভাবে দেশ শাসন করা হাসিনা এখন ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, গত বছর নিহত আন্দোলনকারীদের পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন কি না, তখন হাসিনা বলেন, ‘আমি আমাদের জাতি হিসেবে হারানো প্রতিটি সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয় ও বন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করি এবং তা করতে থাকব।’

সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা গত বছরের বিক্ষোভ দমনের সময়কার কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তিগত দায় স্বীকার করেন না, আর ওই আন্দোলন ছিল একটি সহিংস বিদ্রোহ।

শেখ হাসিনার দাবি, বেশিসংখ্যক প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিল ‘মাঠপর্যায়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন নেতা হিসেবে আমি অবশ্যই সামগ্রিক দায় স্বীকার করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে—যে আমি নিজে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালাতে বলেছিলাম, এটা ঠিক নয়।’

শেখ হাসিনা দাবি করেন, প্রথম দিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর সরকারই একটি স্বাধীন তদন্ত শুরু করেছিল, কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি একই কথা বলেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘চেইন অব কমান্ডের মধ্যে কিছু ভুল অবশ্যই হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত ছিল পরিমিত, সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং যতটা সম্ভব প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যে।’ তিনি এ প্রসঙ্গে ইনডিপেনডেন্টকে আরও বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, যাঁদের সুপ্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম পরিচালনাবিষয়ক নির্দেশিকা মেনে চলার কথা ছিল। এসব নির্দেশিকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া ছিল। এমনটা হতে পারে যে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যেগুলো ভুল ছিল।’

নিজের বিচার প্রসঙ্গে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম চলছে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের। শেখ হাসিনাকে ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করা হয়েছে। অভিযোগ হচ্ছে, হাসিনা ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ফলে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হন।

শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, ছাত্র আন্দোলনের সময়ের ১ হাজার ৪০০ মৃত্যুর সংখ্যাটি ‘অতিরঞ্জিত’। তাঁর ভাষায়, ‘এই সংখ্যা ট্রাইব্যুনালের প্রচারণার কাজে লাগে, কিন্তু বাস্তবে তা বাড়িয়ে বলা।’

শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ইনডিপেনডেন্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশের স্ক্রিনশট
শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ইনডিপেনডেন্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশের স্ক্রিনশট

এ নিয়ে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘যদি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তাতে আমি অবাক হব না বা ভয়ও পাব না। এটি একটি প্রহসনের বিচার, যার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনাল একটি প্রহসনের আদালত, যেটি পরিচালনা করছে আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে গঠিত একটি অনির্বাচিত সরকার। এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেই আমাকে সরাতে যেকোনো কিছু করতে পারে।’

ইনডিপেনডেন্ট প্রতিবেদনে লিখেছে, আদালতে এমন অডিও রেকর্ডিং বাজানো হয়েছে, যেখানে হাসিনাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে বলছেন। তবে শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, এই রেকর্ডিংগুলো প্রসঙ্গের বাইরে কেটে নেওয়া ও বিকৃত করা হয়েছে। হাসিনা এ নিয়ে বলেছেন, ‘সহিংসতা ঘটেছে মাঠপর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে, সরকারের আদেশে নয়।’

দ্য ইনডিপেনডেন্ট এ পর্যায়ে মন্তব্য করে বলেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা হবে এবং সম্ভবত তিনি জানেন ইতিহাস তাঁকে সদয়ভাবে বিচার করবে না। যদিও শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সহিংস বিদ্রোহের মুখে দেশ রক্ষায় সাংবিধানিক কর্তব্য পালনের জন্য গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত নয়।’

শেখ হাসিনা সব দায় অস্বীকার করলেও দ্য ইনডিপেনডেন্ট মন্তব্য করেছে যে গত বছর বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল, তা বিশ্বকে শোকার্ত করে তুলেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ–আঞ্চলিক পরিচালক বাবু রাম পান্ত তখন বলেছিলেন, বাড়তে থাকা মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বিক্ষোভকারী বা ভিন্নমতের প্রতি একেবারেই অসহিষ্ণুতাকে তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক তখন বলেছিলেন, ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ বিশেষভাবে দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সহিংস ঘটনা। পাশাপাশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই হাসিনা সরকারকে বিরোধীদের দমন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার ও একতরফা নির্বাচনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল।

দেশত্যাগ ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে

দেশত্যাগ প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ায় তিনি চলে যান। তিনি বলেন, ‘থেকে গেলে আমার জীবন যেমন ঝুঁকিতে পড়ত, আশপাশের মানুষদের জীবনও তেমনি বিপদে পড়ত।’ তবে নির্বাসনে থাকলেও তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এখনো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর ভাষায়, ‘শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনই দেশকে সুস্থ করতে পারে।’

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো সরকার যদি এমন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়, যেখানে তাঁর দল থাকবে না, তবে তিনি সেই সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ফিরবেন না। তিনি ভারতে থাকার পরিকল্পনা করেছেন।’

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ একদিন আবার বাংলাদেশের ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখবে, সরকারে থাকুক বা বিরোধী দলে। আর এই দল পরিচালনার জন্য তাঁর পরিবার দরকার নেই। তিনি বলেন, ‘এটা আমার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সংবিধান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে না।’

তবে এ ক্ষেত্রে রয়টার্স উল্লেখ করে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী তাঁর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ গত বছর রয়টার্সকে বলেছিলেন যে দল চাইলে তিনি নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করতে পারেন।

ভোট বর্জন

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে তাদের কোটি কোটি সমর্থক নির্বাচন বর্জন করবে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অবিচারই নয়, এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনী বৈধতা থাকতে হবে। কোটি কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এখন যে অবস্থা রয়েছে, তাতে তারা ভোট দেবে না। আপনি যদি একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চান, তাহলে আপনি কোটি কোটি ভোটারকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’

আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে সে আশা প্রকাশ করেছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্যান্য দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি, বোধোদয় হবে এবং আমাদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে।’

আর এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগসহ সব বড় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাঁর দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা মানে দেশে ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বপন করা।

গুম নিয়ে কথা বলেননি

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর তাঁর সমর্থকদের ওপর বড় ধরনের দমন অভিযান চালানো হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি অভিযানে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা রাষ্ট্র অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।

এ নিয়ে রয়টার্স সবশেষে বলেছে, তবে নিজের শাসনামলে গোপন আটককেন্দ্রে নিখোঁজ হওয়া শত শত মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে শেখ হাসিনা কিছুই বলেননি।