বুক থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত মোটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। দুই হাত পোড়া দগদগে ক্ষত। পুরো মাথায় ক্ষতবিক্ষত আঘাতের চিহ্ন। হাসপাতালের বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির শিকার ১০ বছরের ছোট্ট শেখ সাইবা মেহজাবিন। ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠে। মায়ের কাছে জানতে চায়, এভাবে আর কতদিন শুয়ে থাকব, মা? কবে স্কুলে যাব? ছোট্ট সোনামণির এমন প্রশ্নের উত্তর কী আর মায়ের কাছে আছে! বেদনায় নীল হয়ে যান মা। হাহাকারে বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। নিঃশব্দে অশ্রু ঝড়ে মায়ের দুগাল বেয়ে। মিথ্যা সান্ত্বনা দেন মেয়েকে। যখন স্কুল আঙিনায় আনন্দঘন পরিবেশে হইচই করে বেড়ানোর কথা, সহপাঠীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্লাস আড্ডায় মেতে থাকার কথা, সেই মেহজাবিন আজ জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে হাসপাতালের কেবিনে। প্রিয় স্কুল এখন তাদের কাছে বিভীষিকাময় স্মৃতির নাম। মেহজাবিনের আর কখনো স্কুলে ফেরা হবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই! গতকাল জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ১৩০৬ নম্বর কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, ব্যান্ডেজে মোড়া মেহজাবিনের মাথার ক্ষতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন তার মা শারমিন ইয়াসমিন। কেবিনের পাশেই ফ্লোরিং করে ঘুমান বাবা ও মা। তার পাশে একটি ছোট তাকওয়ালা আলমারিতে জামা-কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা। যেন হাসপাতালের কেবিনেই শিফট হয়েছে তাদের সাজানো গোছানো সংসার। মেহজাবিনের মা শারমিন বলেন, আমার মেহজাবিনের তো পুরো শরীর পুড়ে গেছে। ওর জীবন বাঁচাতে ওর বাবা চাকরি ছেড়েছে। আমাদের পুরো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হলো না।’
মেহজাবিনের বাবা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ওদের জীবন তো শেষই, এখন শুধুই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলছে। কিন্তু মেয়েটার শরীরে কিছু বাকি নেই, বাঁচবে কীভাবে? শুধু মেহজাবিনের বাবাই নয়, প্রায় সাড়ে ৩ মাস আগে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখনো বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি সবার বাবা-মা নিজ নিজ সন্তানের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ ও আজীবনের চিকিৎসার নিশ্চয়তা দাবি করেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, এখনো মাইলস্টোনের ঘটনায় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন। ছাড়পত্র দেওয়ার পরও লম্বা সময় চিকিৎসার মধ্যেই থাকতে হবে এসব ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে।
এদিকে, ১৩০৫ নম্বর কেবিনে কানের ব্যথায় আর্তনাদ করছিল সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়ান আফিফ (১২)। মা লাভলী পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। লাভলী বলেন, ৩৭ শতাংশ দগ্ধ শরীর। কাউন্সেলিংয়েও কাজ হচ্ছে না। যন্ত্রণায় ছটফট করে। আজ সকালে বলেছে, মা ব্যথা আর সহ্য হয় না। চাকু এনে আমাকে মেরে ফেলো। এসব বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেফু পড়েন। ক্রন্দনরত অবস্থায় তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ওর বাবা মারা যায়। সন্তানকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম, ওর জীবনও ঝুঁকিতে।
১৩৬৬ নম্বর কেবিনে পাশাপাশি বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে জমজ দুই বোন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শায়রা ও শায়মা। তাদের মা আখলিমা বলেন, এখানে আসার প্রথম দিকের দুর্বিষহ সময়গুলো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ওরা সুস্থ হয়ে উঠছে এটাই শান্তি। বাকিটা জীবনে কতটা সুস্থ থাকবে, সেটিই আমাদের চিন্তা। ১৪৪২ নম্বর কেবিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরেক শিক্ষার্থী আবিদুর রহিম (১০)। তার অবস্থা অন্যদের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক ডা. মো. মারুফুল ইসলাম বলেন, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে এখানে ভর্তি পাঁচজনের জীবনের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন সবই করা হচ্ছে। দু-একজনের ছোট ছোট অপারেশন লাগতে পারে। আর ছাড়পত্রের পরে সাইকো থেরাপি ও ফিজিও থেরাপি চলমান রাখতে হবে।
চলতি বছরের ২১ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২৭ শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩৪ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক।