গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিনটি মামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান ২৫ সেনা কর্মকর্তার (যাদের মধ্যে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা সংক্ষেপে ডিজিএফআইয়ের সাবেক কয়েকজন প্রধানও রয়েছেন) বিচার সম্প্রতি শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে দুটি মামলায় সাবেক ও কর্মরত মিলিয়ে ২৪ জন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ৯ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ২২ অক্টোবর বর্তমানে কর্মরত ১৫ জন কর্মকর্তাকে আদালতে হাজিরের পর তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে তার বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা সংঘটিত গুম ও খুনের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের দাবি সামনে আসতে থাকে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গ অব্যাহতভাবে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়ী কর্মকর্তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন।
এরই মধ্যে চলতি বছরের জুন মাসে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিভিন্ন ইউনিট কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকাণ্ড বিস্তারিত তুলে ধরে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় গুম কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্য স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্স ডিজঅ্যাপায়েরেন্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়া হয়।
অনলাইনে সংঘবদ্ধ প্রচারণা
গুম খুনে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার ওপর জুন মাসে যখন গুম কমিশনের রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় এবং এরপর বিচারের দাবি জোরালো হতে শুরু করে, এবং সর্বশেষ অক্টোবর মাসে ট্রাইব্যুনালে সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন এর সমান্তরালে অনলাইনে চলতে থাকে একটি ব্যাপক সংঘবদ্ধ বেনামি প্রচারণা; যেখানে এই বিচার প্রক্রিয়াকে নিয়ে নানান প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, বিচারকে নাটকের ‘সাজানো স্ক্রিপ্ট’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সবাইকে ‘নির্দোষ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং বিচারের দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে সোচ্চার এমন কয়েকজন ব্যক্তিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে শত শত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে।
এই প্রচারণায় অংশ নেয়া অন্তত ৬৭টি ফেসবুক পেইজকে চিহ্নিত করেছে দ্য ডিসেন্ট। এর মধ্যে কিছু পেইজ গত এক থেকে দুই মাসের মধ্যে জন্ম নেয়া, এবং কিছু পেইজ পুরনো; যেগুলোতে মাঝে মাঝেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংক্রান্ত ইস্যুতে ইতিবাচক বিভিন্ন পোস্ট দেয়া হয়ে থাকে বলে অনুসন্ধানে দেখা গেছে।
দ্য ডিসেন্ট এসব পেইজে গত জুন মাস থেকে চলতি অক্টোবরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত ৫৪৭টি বিজ্ঞাপন খুঁজে পেয়েছে; যেগুলোতে গুম খুনের জন্য দায়ী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য সোচ্চার কয়েকজন ব্যক্তিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে প্রচার করা হয়েছে। অনুসন্ধানকৃত বিজ্ঞাপন বা পোস্টের সময়কাল চলতি বছরের জুন মাসের শুরু থেকে অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ পর্যন্ত। অর্থাৎ, যেসব বিজ্ঞাপন এবং পোস্টের কথা এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হবে সেগুলো জুন মাসের ৩ তারিখ থেকে অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখের মধ্যে ওইসব পেইজে পোস্ট করা হয়েছে। এই সময়কালের আগেও একই ইস্যুতে অল্প কিছু বিজ্ঞাপন পাওয়া গেলেও জুন মাসের ৩ তারিখ থেকে বিজ্ঞাপনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জুন মাসকে এই অনুসন্ধানে ‘শুরুর মাস’ হিসেবে ধরা হয়েছে।
এই সময়েরেখার মধ্যে বিজ্ঞাপনের বাইরেও এসব পেইজ থেকে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক’ ‘পক্ষপাতমূলক’-- ইত্যাদি শব্দের দ্বারা ফ্রেইম করে কন্টেন্ট (টেক্সট, ছবি, রিলস, ডকুমেনটারি) প্রকাশ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে এই প্রচারণাটিকে সংঘবদ্ধ এবং সমন্বিত (Coordinated) বলে বেশ কিছু লক্ষণ পাওয়া গেছে।
যেমন, একই ক্যাপশন/ফটোকার্ড অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেকগুলো পেইজে পোস্ট করা হয়। এবং এসব পোস্ট ও ফটোকার্ড নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বহু পেইজে কাছাকাছি সময়ে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রমোট করে রিচ বাড়ানো হয়। সেই সঙ্গে পেইজগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু হ্যাশট্যাগের ঘনঘন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় (#ICT, #army, #গুম, #DGFI, #mediatrail, #fakenews ইত্যাদি)।
এসব পেইজের পোস্টগুলোকে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রমোট করার টাইমও অনেক ক্ষেত্রে হুবহু মিলে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনের কথা। সেখানে পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "পিনাকি ভট্টাচার্যের জীবন যেন এক রঙ বদলানো নাটক। বামপন্থী থেকে ইসলামপন্থী, ব্যবসায়ী থেকে নির্বাসিত ভ্লগার। ইতিহাস বিকৃতি, ভেজাল ওষুধ কেলেঙ্কারি আর উসকানিমূলক প্রোপাগান্ডা দিয়ে তিনি নিজেকে আলোচনায় রাখলেও, থেকে গেছেন নৈতিক দায় এড়িয়ে যাওয়া ও দায়িত্বহীনতার প্রতীকে।"
এই ফেসবুক পোস্টটি BanglaZ, গণ টকশোতন্ত্র, Wikileaks V.2, বাংলার বাণী, Flash Feed ও ‘সময়ের অসঙ্গতি’ নামের পেইজগুলোতে ২০২৫ সালের ৪ অক্টোবর সকাল ঠিক ৭টায় এক সাথে বিজ্ঞাপন আকারে প্রমোট করা হয়েছে।
এরকম আরও উদাহরণ আছে।
৩ অক্টোবর সকাল ৭টায় চারটি পেইজে ঠিক একই টাইমে বিজ্ঞাপন আকারে প্রমোট করা হয়েছে নিচের ক্যাপশনের পোস্টটি: “ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুর, ছিল এক আত্মঘাতী পদক্ষেপ। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন তো হয়নি, বরং তাদের প্রতি সহানুভূতি বেড়েছে। এমন ধ্বংসাত্মক কর্ম শুধু দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কলঙ্ক ডেকে এনেছে। #PinakiBhattacharya #fblifestyle #foryouシpage"।
এভাবে ৬৭টি ফেসবুক পেইজের ৫৪৭টি বিজ্ঞাপনের মধ্যে ৫৪১টি ঠিক সকাল ৭টায় প্রমোট করা হয়েছে। শুধুমাত্র ৪টি বিজ্ঞাপনের প্রমোট করার টাইম সকাল ৮টা।
এসব বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ভিজ্যুয়াল উপাদানে —ফটোকার্ড, মিম— কখনো কখনো এডিটেড/ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞাপনী পোস্টের টেক্সটে অনেক ক্ষেত্রে আবেগঘন ভাষা ব্যবহার আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপেশাদার নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার কিম্বা সমালোচিত ব্যক্তির নাম বিকৃতি– ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়েছে।
৫৪৭টি বিজ্ঞাপন ছাড়াও এই ফেসবুক পেইজগুলোতে আরও বহু কন্টেন্ট (টেক্সট, ছবি ভিডিও) রয়েছে যেগুলোতে একই রকম বক্তব্য ও দাবি প্রচার করা হয়েছে। যদিও এরকম পোস্টের মোট সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা ১০টি ফেসবুক পেইজে মোট ৩২৫টি বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রচারকারী ১০টি পেইজ | ফেসবুক
দ্য ডিসেন্ট সংঘবদ্ধ প্রচারণাটি অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে এর ধরণ এবং কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রচারণায় অংশ নেওয়া পেইজগুলো যেসব তথ্য ও বক্তব্য ব্যবহার করেছে সেগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে দেখেনি দ্য ডিসেন্ট। বরং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বেনামি একটি সংঘবদ্ধ প্রচারণার গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য খুঁজে দেখা হয়েছে এই অনুসন্ধানে।
কী প্রচার করা হচ্ছে
সংঘবদ্ধ অনলাইন প্রচারণায় পোস্ট করা বিজ্ঞাপনগুলোতে আসলে কী প্রচার করা হয়েছে এবং হচ্ছে? বিজ্ঞাপনগুলোতে মূল উপজীব্য হলেন কয়েকজন ব্যক্তি। তাদের সংখ্যা অন্তত সাতজন। এই ব্যক্তিরা হলেন- লেখক ও ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির, কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান, লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ সরকারের গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস, সাংবাদিক ও ইউটিউবার ইলিয়াস হোসাইন এবং সাংবাদিক ও ইউটিউবার কনক সারওয়ার।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪১৬টি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। এরপর সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের নাম পাওয়া গেছে ১২৯টি বিজ্ঞাপনে। সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে নিয়ে ৫৭টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ১০০টি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে আর কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমানের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে ৬৫টি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসিরের বিরুদ্ধে ছিল ২৪টি বিজ্ঞাপন এবং গুম কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিসকে নিয়ে প্রচার করা হয়েছে ১০টি বিজ্ঞাপন। অনেকগুলো বিজ্ঞাপনে এই ব্যক্তিদের একাধিকজনের নাম ছিল। যেমন- পিনাকীর বিরুদ্ধে প্রচার করা কিছু বিজ্ঞাপনে ইলিয়াস হোসাইন বা কনক সরোয়ার বা লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমানের নামও ছিল।

ইলিয়াস হোসাইনকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন | মেটা অ্যাড লাইব্রেরি
এই ব্যক্তিদেরকে বিজ্ঞাপনগুলোতে “গুজববাজ”, “রাষ্ট্রবিরোধী” বা “বিদেশি প্রভাবিত” ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। কোন কোন বিজ্ঞাপনে এই ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতারের আহ্বান করা হয়েছে।
মোট ৫৪৭টি বিজ্ঞাপনের জন্য জুন মাস থেকে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে খরচ হওয়া টাকার পরিমাণ সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে।
উপরিউক্ত ব্যক্তিদের নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপনের পাশপাশি আরও কিছু বিষয় বিজ্ঞাপনের কন্টেন্টে খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, বিজ্ঞাপনগুলোতে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে “পেশাদার, সুশৃঙ্খল, জাতির গর্ব” হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে; সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের “স্থিতি ও নিরাপত্তার প্রতীক” বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআইকে “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য” বলে উল্লেখ করা হয়েছে অনেক বিজ্ঞাপনে।
একই সঙ্গে “অপরাধ ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠানের নয়” যুক্তিটি বহু বিজ্ঞাপনে স্থান পেয়েছে।
বিচার নিয়ে যারা সোচ্চার, প্রচারণা তাদের বিরুদ্ধে
দ্য ডিসেন্ট এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিজ্ঞাপনগুলোর মূল উপজীব্য হিসেবে যে সাতজন ব্যক্তির নাম আগে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের ব্যাপারে একটি বিষয় সাধারণ (Common)। আর তা হলো, তারা সবাই গুম ও খুনের সাথে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বিচারের বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সোচ্চার। একইসাথে এই সাতজন ব্যক্তির কয়েকজন বর্তমান সেনাপ্রধান বা আরও কিছু সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে এসব লেখালেখির ভাষা আক্রমাণাত্মক ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে অনির্ভরযোগ্য সূত্রের ওপর ভিত্তি করে লেখালেখি করা হয়েছে বলে দ্য ডিসেন্ট এর রিভিউতে পলিক্ষিত হয়েছে।
৯ অক্টোবরের যে দুটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, এর মধ্যে একটি মামলার বাদী হলেন লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) হাসিনুর রহমান। নেত্র নিউজের ২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাকে ২০১৮ সালে গুম করে ডিজিএফআই’র গোপন কারাগারে রাখা হয় এবং ২০২০ সালে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর ১১ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেন।
এরপর থেকে ফেসবুকে তাকে নিয়ে শুরু হয় নেতিবাচক প্রচারণা। অন্তত ৬টি ফেসবুক পেইজ থেকে তাকে নিয়ে চলছে ধারাবাহিক ক্যাম্পেইন। কোথাও তাকে অভিহিত করা হয়েছে, ‘একজন গুমকারী প্রাক্তন সেনা অফিসার’। আবার কোথাও বলা হচ্ছে, ‘তিনি একজন ক্রসফায়ার স্পেশালিস্ট’ এবং তাকে নিয়ে প্রায় সবগুলো বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘তিনি ন্যায়বিচার নয়, প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছেন’।

কর্নেল হাসিনাকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন | মেটা অ্যাড লাইব্রেরি
যে ৬টি ফেসবুক পেইজ থেকে টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন আকারে কর্নেল হাসিনকে নিয়ে নেতিবাচকভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেগুলো যথাক্রমে: কাগজের গল্প, Xpress News, রঙিন চশমা, Viral Fact, Power of People, গণ টকশোতন্ত্র । এই ৬টি পেইজের তিনটি গত সেপ্টেম্বর মাসে খোলা হয়েছে, আর বাকিগুলো দুই থেকে তিন বছর আগে খোলা। হাসিনুরের বিরুদ্ধে আরও বিভিন্ন পেইজ মিলে অন্তত ৬৫টি বিজ্ঞাপন খুঁজে পাওয়া গেছে।
এই পেইজগুলো থেকে শুধু কর্নেল হাসিন নয়, সেনাবাহিনীর আরও দুজন সাবেক সদস্য লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসিরের বিরুদ্ধেও বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে।
এসব বিজ্ঞাপনে লে. কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তিনি সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়ান”। এছাড়া তাকে খালেদা জিয়ার বাড়ি উচ্ছেদ ও ‘কর্নেল হাসিনুরের গুমে সম্পৃক্ত’, পরে ‘বিদেশে বসে সেনাবাহিনী-বিরোধী গুজব-বাণিজ্য’ চালানো উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; যার মুখ্য লক্ষ্য নাকি ‘সেনাবাহিনীর মনোবল ভাঙা ও রাষ্ট্রকে দুর্বল করা’।
একাধিক পেইজ থেকে তাকে গ্রেফতার করার দাবিও তোলা হয়েছে।

লেফটেনেন্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন | মেটা অ্যাড লাইব্রেরি
‘কর্নেল মুস্তাফিজ’ ও ‘মোস্তাফিজ’ কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে মেটার এড লাইব্রেরিতে তাকে নিয়ে নেতিবাচক অন্তত ১০০টি বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে যা এই বছরের মে মাস থেকে চলছে। এছাড়া গত ২৪ সালের ৫ আগস্টের আগেও তাকে নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় মেটা এড লাইব্রেরিতে। কর্নেল হাসিনকে নিয়ে প্রচারণা চালানো ৬টি পেইজের অন্তত ৫টিতেই কর্নেল মুস্তাফিজ সম্পর্কেও নেতিবাচক বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।
আরেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসিরকে নিয়ে অন্তত ২৪টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। এসব বিজ্ঞাপনে ব্রিগেডিয়ার নাসিরের বক্তব্য/আচরণকে “বাহিনীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন, মনোবল ও নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ এবং রাজনৈতিক বিতর্কে টেনে আনা” হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) হাসান নাসিরকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন | মেটা অ্যাড লাইব্রেরি
৫ আগস্টের পর ব্রিগেডিয়ার নাসিরকে সেনাসদরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। এই প্রসঙ্গটি টেনে একাধিক বিজ্ঞাপনে অবাঞ্ছিত ঘোষণার সিদ্ধান্তকে “প্রতিরোধমূলক ও যুক্তিসঙ্গত” বলে অভিহিত করা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির ও লে. কর্নেল মুস্তাফিজকে নিয়ে অন্তত ১৪টি ফেসবুক পেইজে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুক পেইজগুলোর নাম যথাক্রমে, Single Squad, Nispapツ, BanglaZ, জনগণের কণ্ঠস্বর, Bengali Emotion, আমাদের ব্রহ্মপুত্র-By Seba Hot News, Chetonar Bangladesh, সেনাবাহিনী আমার অহংকার, গণ টকশোতন্ত্র, আওয়াজ উঠাও বাংলাদেশ, Mail Dhaka 24.com, দেশে বিদেশে, Voice of Rights, Trending Bangladesh, ইনসাইড স্টোরি, Viral Fact।
উল্লেখ্য, লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির তাদের সামাজিক মাধ্যম একাউন্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে এর বিচার দাবি এবং সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সরব বিরোধিতা করছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
উদাহরণস্বরূপ, ২৩ অক্টোবর লেফট্যানেন্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লেখেন, “অপরাধী অফিসারদের জনগণের সামনে খুল্লাম খুল্লা সুবিধা দেয়া আসলে জেনারেল ওয়াকারের মাসল পাওয়ার প্রদর্শন। সেইম অন স্বরাষ্ট্রে উপদেষ্টা সেইম অন আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহার, সেইম অন প্রফেসর ইউনুস।"
একইভাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপারে স্বাধীন মিলিটারি রিফর্ম কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। হাসান নাসির ডিজিএফআই পরিচালিত ‘আয়নাঘর’ বন্দীদের মুক্তির দাবিতেও আন্দোলন করে আসছিলেন।
উপরের উল্লিখিত ১৪টি ফেসবুক পেইজের অন্তত ৬টিতে বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কাজ করছেন এমন একজনকে নিয়ে নেতিবাচক বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। তিনি হলেন বাংলাদেশের গুম তদন্ত কমিশনের সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস।
এই ৬টি ফেসবুক পেইজ হল, Single Squad, Nispapツ, আওয়াজ উঠাও বাংলাদেশ, Mail Dhaka 24.com, Trending Bangladesh এবং Viral Fact.

ড. নাবিলা ইদ্রিসকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন | মেটা অ্যাড লাইব্রেরি
হাসান নাসির ও মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা পেইজের তালিকার বাইরে আরও অন্তত ৪টি পেইজে ১৪–২৫ অক্টোবর ২০২৫ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ১০টি নেতিবাচক বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে নাবিলা ইদ্রিসের বিরুদ্ধে। সেই পেইজগুলো হল: সমকালীন বাংলাদেশ, Power of People, নতুন দিগন্ত, BD News.
বিজ্ঞাপনগুলোর মূল বয়ান: ড. নাবিলা ইদ্রিস গুম কমিশনকে “রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার” বানাচ্ছেন এবং সেনাবাহিনী এবং সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে “মিডিয়া ট্রায়াল” চালাচ্ছেন। এতে সেনাবাহিনীর “প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে”-- এই বক্তব্য বারবার এসেছে বিজ্ঞাপনগুলোতে।
Mail Dhaka 24.com, Power of People, আওয়াজ উঠাও বাংলাদেশ, Nispapツ, সমকালীন বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি পোস্টে হুবহু একই ভাষায় “মিডিয়া ট্রায়াল/প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম” ফ্রেইমটি প্রচার করতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও (নাবিলার কারণে) UN শান্তিরক্ষা মিশনের সম্ভাব্য ক্ষতির কথাও যুক্ত করা হয়েছে।
Viral Fact ও Single Squad– এ দুটি পেইজে নাবিলার সাথে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামকে যুক্ত করে অভিযোগ করা হয়েছে তারা উভয়ে মিলে— আইসিটিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে নয়, বরং নির্বাচনপূর্ব সময়ে সেনাবাহিনীকে চাপে ফেলার কৌশল অবলম্বন করেছেন।
সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন পিনাকী ভট্টাচার্য্য'র বিরুদ্ধে
পুরো সংঘবদ্ধ ক্যাম্পেইনটিতে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দেখা গেছে, লেখক ও ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য্য’র বিরুদ্ধে। ২০২৪ এর অক্টোবর থেকে চলতি অক্টোবরের ২৭ তারিখ পর্যন্ত পঞ্চাশের অধিক ফেসবুক পেইজ থেকে তার নানান কার্যক্রমের সমালোচনা করে প্রায় ৪১৬টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। তবে এর বেশিরভাগ বিজ্ঞাপন চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে প্রচারিত এবং এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়েছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে।
কোন বিজ্ঞাপনে এককভাবে তার সমালোচনা করা হয়েছে, আবার কখনো তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে সাংবাদিক ইলিয়াস এবং সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে। এছাড়া কিছু বিজ্ঞাপনে কর্নেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমানকেও পিনাকীর সাথে জড়িয়ে সমালোচনা করা হয়েছে।
যেমন, গত ২১ সেপ্টেম্বর বাংলার বানী নামের একটি ফেসবুক পেইজ থেকে ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি পোস্ট করা হয়। পোস্টের ক্যাপশনে ছিল, “২০০৮ সালের ভয়াবহ নকল ওষুধ কেলেঙ্কারির নেপথ্যে পিনাকি ভট্টাচার্যের নাম আজও উচ্চারিত হয়। তাঁর কোম্পানির সরবরাহ করা কালাজ্বরের ওষুধে কার্যকর কোনো উপাদান না থাকায় প্রায় ২৮৯ রোগীর মৃত্যু হয় এবং হাজারো মানুষ মারাত্মক জটিলতায় ভুগে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসকে উপেক্ষা করে মুনাফার লোভে কীভাবে মানুষের মৃত্যু ডেকে আনা হয়েছিল। অথচ আজও বিচার হয়নি, বরং তিনি বিদেশে বসে ভুয়া তথ্য ও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।"
সাথে একটি ফটোকার্ডও যুক্ত করা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল, “পিনাকীর নকল ওষুধ কেলেঙ্কারিতে ২৮৯ রোগীর মৃত্যু”। এই ফটোকার্ডসহ পোস্টটি করা হয়, ২১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪টা ৫৯ মিনিটে।
একই ক্যাপশন দিয়ে সার্চ দিয়ে দেখা যায়, একই ফটোকার্ড একই ক্যাপশনে আরও অন্তত ৭টি ফেসবুক পেইজে পোস্ট করা হয়েছে সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখ বিকাল ৪-৫টার মধ্যে।
অর্থাৎ, দেড় ঘণ্টার মধ্যে একই ক্যাপশন এবং ফটোকার্ড বিভিন্ন ডিজাইনে প্রকাশ করা হয়েছে ওই ফেসবুক পেইজগুলোতে।

পিনাকী ভট্টচার্য্যকে নিয়ে একটি পোস্ট একসাথে ৮টি পেইজে প্রকাশ করা হয় | ফেসবুক
বাকি পেইজগুলোর নাম যথাক্রমে গণ টকশোতন্ত্র, Wikileaks V.2, স্বদেশ, সংস্কার, সময়ের অসঙ্গতি, Flash Feed, বিবর্তন।
‘পিনাকী এবং কালাজ্বর’ কীওয়ার্ড সার্চ করে দেখা যায়, এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক প্রথম আলোতে, ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর যা ইবাংলাহেলথ ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে পূন:প্রকাশিত হয়েছিল।
সেখানে বলা হয়েছে, “কালাজ্বর নির্মূলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত মে মাসে রোগীদের যে মিল্টেফস (মিল্টেফসিন) ক্যাপসুল খাওয়ানো শুরু করেছিল, তার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১১ সেপ্টেম্বর ক্যাপসুলটি দিয়ে কালাজ্বরের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। ওষুধ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডকে ক্যাপসুলটির উৎপাদন, মজুদ ও বিপণন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখারও নির্দেশ দিয়েছে।"
প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে ডা· পিনাকী ভট্টাচার্য এর বক্তব্যও উদ্ধৃত হয়েছে। এছাড়া ঘটনাটি নিয়ে পিনাকী তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটেও নিজের বক্তব্য প্রকাশ করেছিলেন ২০১৯ সালে।
তবে এই মিল্টেফস বা মিল্টেফসিনের কারণে বাংলাদেশে ২৮৯ জন মারা গেছে এমন কোনো খবর কোনো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূলত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিক মাসুদ কামালের ইউটিউব চ্যানেল ‘কথা’-তে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ঔষধের কারণে ২৮৯ জন মারা যাওয়ার দাবিটি প্রথম উঠে আসে। দাবিটি করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। ‘এক হিসেবে এমন মৃত্যুর খবর এসেছে’ বলে তিনি দাবি করলেও সেই হিসেবের পক্ষে কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি। সেটিই পরে একাধিক সংবাদমাধ্যম হয়ে সংঘবদ্ধ ফেসবুকে প্রচারণায় উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপনদাতা পেইজগুলো বিভিন্ন গুচ্ছ-তে বিভক্ত
অনুসন্ধানে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, বিজ্ঞাপন প্রচারকারী পেইজগুলো সব একই রকম নয়। এবং একই জায়গা থেকেও পরিচালিত নয়। কয়েকটি পেইজের আচরণ এবং পরিচালনাকারীদের মধ্যে কিছু সামঞ্জস্য থাকলেও অন্য আরও কয়েকটি পেইজের আচরণ এবং পরিচালনাকারীদের মধ্যে ভিন্নরকম সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়। এভাবে এসব পেইজ একাধিক গুচ্ছ বা ক্লাস্টারে বিভক্ত। পিনাকী ভট্টচার্য্যকে নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে একসাথে বেশ কয়েকটি পোস্ট ও বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করা যে ৮টি পেইজের কথা উপরে বলা হয়েছে সেগুলোকে একটি ‘গুচ্ছ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পিনাকী সংক্রান্ত একেকটি পোস্ট এই ৮টি পেইজ নিজেদের মধ্যে কপিপেস্ট করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে, কিন্তু হুবহু একই পোস্ট পিনাকীকে নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারকারী বা পোস্টকারী অন্য পেইজগুলোতে পাওয়া যায় না। আবার এই ৮টি পেইজের এডমিনদের লোকেশনও কমন। যেমন প্রতিটি পেইজে ৩ বা ৪জন করে এডমিন রয়েছেন কিন্তু প্রতি পেইজেই একজন এডমিন কানাডাতে থাকেন বলে পেইজ ট্রান্সপারেন্সিতে দেখা যায়। একজন ছাড়া প্রতি পেইজের বাকি এডমিনরা বাংলাদেশে থাকেন।
এরকম আরও ১০টির মতো পেইজকে আরেকটি গুচ্ছ-তেও রাখা যায় যেখানে ওই পেইজগুলো খোলার সময়, পোস্ট কপিপেস্ট করার প্রবণতা, পেইজের অন্যান্য পোস্টের বিষয়বস্তু এবং এডমিনদের লোকেশন বিবেচনায় বেশ কিছু বিষয় পরস্পরে মিলে যায়।
চিহ্নিত ৬৭টি পেইজের মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে যেগুলো কয়েক বছর আগে খোলা। এসব পেইজের একটি কমন বৈশিষ্ট্য হলো পেইজগুলোর নাম বারবার পরিবর্তিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
যেমন- Xpress News পেইজটির নাম একদম শুরুতে ২০১৬ সালে ছিল ”সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম”। এরপর বদলে নাম দেয়া হয়, “সিএইচটি জার্নাল”। পরে নাম দেয়া হয়, “Bechelor Point All Season”, এর কিছুদিন পরে আবারও নাম বদলে রাখা হয়, “Bechelor Point Season 4”। কিছুদিন পর নাম বদলে রাখা হয়, “Khagrachhari Express/খাগড়াছড়ি এক্সপ্রেস”।
“বাংলার বাণী” নামক পেইজটির নাম একদম শুরুতে (২০১৭ সালে) ছিল, “CHT photography” এরপর নাম দেয়া হয়, “CHT Tour”। অত:পর নাম হয়, “Organic Products Of CHT” এবং এরপর “Dream Aviary”।
Voice of Rights নামক পেইজটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে খোলার সময় নাম ছিল, “Alhamdulillah”.

দুটি পেইজের নাম বদলের হিস্টোরি | ফেসবুক
ডিজিএফআই-কে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন
বিজ্ঞাপনগুলোতে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যক্তি আক্রমণমূলক শব্দের ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে। একইসাথে সেনাবাহিনীকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
যেমন, পিনাকী ভট্টাচার্যকে “গুজববাজ”, “ভণ্ড”, “রাষ্ট্রবিরোধী” ও “ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এজেন্ট” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনকে “হলুদ সাংবাদিক” হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে; কনক সরওয়ারকে “তিন বান্দরের” একজন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

কনক সরোয়ারকে নিয়ে প্রচারিত কয়েকটি বিজ্ঞাপন
গণ টকশোতন্ত্র পেইজের এক পোস্টে বলা হয়, “পিনাকি ভট্টাচার্যের মত ইতিহাসবিকৃতকারীরা বিদেশি এজেন্ডা চালিয়ে দেশকে বিভ্রান্ত করতে চায়। স্বাধীনতার গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে এখনই সময় এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মুখোশ উন্মোচন করার।”
GenZ Nation পেইজে লেখা হয়, “ইলিয়াস হোসেন সাংবাদিক হিসেবে বা সোশ্যাল মিডিয়া পার্সোনালিটি হিসেবে বিতর্কিত। বিতর্কের কারণ উনার মুখের ভাষা। সেখানে সাংবাদিকসুলভ অবজেক্টিভিটি থাকে না।”
Xpress News পেজ থেকে পোস্ট করা হয়েছে, “পিনাকী-ইলিয়াস গং তাদের অতি প্রিয় প্রার্থীর ভরাডুবি আঁচ করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট—সংঘর্ষ বাধিয়ে শেষে সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করা… পিনাকী-ইলিয়াস গং গুজববাজদের প্রতিহত করুন।”
তবে অনেক বিজ্ঞাপনে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই-কে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে অথবা ডিজিএফআইকে- আলোচ্য ৭ ব্যক্তি কর্তৃক নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলে তার নিন্দা করা হয়েছে।
যেমন- Chetonar Bangladesh পেইজে বলা হয়েছে, “কে জানতো খুন হবে, কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ভিডিও করতে হবে?… তাহলে পিনাকি-ইলিয়াস কেন বিএনপিকে বাঁচাতে সেনাবাহিনী-ডিজিএফআইকে দোষারোপ করছে?”
Bengali Emotion পেইজে লেখা হয়েছে, “বাংলাদেশে গোয়েন্দা সংস্থা না থাকলে উপকার হবে ভারতের — অবাধে এখানে কাজ করতে পারবে… পিনাকীর এজেন্ডা আসলে ভারতের এজেন্ডা।”
Voice of Rights পেইজে লেখা হয়েছে, “ডিজিএফআই বিলুপ্তির উস্কানি পিনাকীর: ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের সামনে দেশ!”
Nispapツ ও Bangladesh Military Insider পেইজের বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে, “৫ই আগস্ট উত্তাল দিনে তিনি খুব নীরবেই শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন… তাঁর সেই নীরবতা ছিল এক অদম্য ঘোষণা। সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান স্যার, এমন এক নাম, যা এখন অনেকের কাছেই বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতার প্রতীক।”
‘অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ পেইজে বলা হয়েছে, “৫ আগস্টের পর দেশের সামনে তিনটি বড় দায়িত্ব ছিল — জুলাই হত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় সংস্কার, আর নির্বাচন… কিন্তু দেশের ভেতরে-বাইরে একটা গোষ্ঠী — ইলিয়াস-পিনাকীগণ — প্রতিদিন সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে অপপ্রচারে ব্যস্ত।”
Power of People পেজে লেখা হয়, “পিনাকী গংদের সবচেয়ে বেশি ফেইল হচ্ছে ক্যু নিয়ে গুজব। কারণ দেশের মানুষ জানে, সেনাপ্রধান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রক্ষা করতে সর্বোচ্চ সচেষ্ট।”
Voice of Rights পেইজে পোস্টে বলা হয়েছে, “সেনাবাহিনী: আস্থার প্রতীক বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে জনগণ আশ্বস্ত হয়… সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানোর দাবি মানে এই আস্থাকে ভেঙে দেওয়া।”
প্রচারণায় ডিপফেক চরিত্রের ব্যবহার
পিনাকী ভট্টাচার্য সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলোর তালিকায় Jahid Hasan Jewel নামের একটি ফেবসুক পেইজ দ্য ডিসেন্টের নজরে আসে। পেইজটি পিনাকীর বিরুদ্ধে অন্তত ৬টি বিজ্ঞাপন চালিয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলোর মূল কথা হল, পিনাকী ভট্টাচার্যের লক্ষ্য ন্যায়বিচার নয়, রাজনৈতিক; এছাড়া ‘ডিজিএফআই বিলুপ্তি’র সমালোচনা করা হয় বিজ্ঞাপনে। পিনাকীর কিছু বক্তব্য ভুল দাবি করে সেগুলো যাচাইয়ের আহ্বানও জানানো হয় একটি বিজ্ঞাপনে। এছাড়া গত আগস্টে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে নুরুল হক নুরুর উপর সেনাসদস্যদের দ্বারা হামলার ঘটনায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করা হয়, এই হামলা ছিল পরিকল্পিত। বলা হয়, ইলিয়াসের হুমকি ও পিনাকীর উস্কানিতে এক যৌথ ষড়যন্ত্রে এই কাণ্ড ঘটে।
পেইজটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি গত বছরের ২৪ অক্টোবর চালু হয়েছে এবং শুরুতে Gen-Z Fact Check তারপর 1 Minute's Fact Check এবং সর্বশেষ Jahid Hasan Jewel নামে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে পেইজটিতে কথিত “ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট” পোস্ট করা হলেও পরে চলতি বছরের আগস্ট থেকে ভিডিও এনালাইসিস প্রকাশ করা শুরু করে। পেইজে একাধিকবার ‘জাহিদ হাসান জুয়েল’ এর পরিচয় হিসাবে লেখা হয়েছে- ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’।

কিন্তু অনলাইনে নানাভাবে সার্চ করে এই নামে কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কোনো লেখা বা ছবি কিংবা ভিডিও এই ফেসবুক পেইজের বাইরে পাওয়া যায়নি। এছাড়া এই পেইজ এবং একই নামের ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভিডিওতে একজন ব্যক্তি কথা বললেও তার চেহারা মডিফাই করার ক্ষেত্রে এআই এর সহায়তা নেয়া হয়ে থাকতে পারে। একাধিক ভিডিও বিশ্লেষণে বেশ কিছু অসামঞ্জস্য ধরা পড়েছে।
যেমন- ২ সেপ্টেম্বর এই চ্যানেলে একটি ভিডিও আপলোড করা হয় যার শিরোনাম ছিল, “নুরের ওপর হামলা—নিঃসন্দেহে পরিকল্পিত"। সেখানে জাহিদ হাসান জুয়েলকে কথা বলতে দেখা যায়, কিন্তু দৃশ্যত তাকে একটু বয়স্ক মনে হয়। ঠিক দুইদিন পর ৪ সেপ্টেম্বর তিনি আরেকটি ভিডিও বিশ্লেষণ পোস্ট করেন যেখানে তাকে আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং ভিন্নতর মনে হয়। এছাড়া প্রায় প্রতিটি ভিডিওতে তার হাতে থাকা ঘড়িতে টাইমের কাটাগুলো একই জায়গায় দেখা যায়; যা এডিট করা কোন টেমপ্লেটের প্রতি ইঙ্গিত করে।

দুইদিন আগে-পরে পোস্ট করা দুটি ভিডিওতে কথিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হাসান জুয়েলের চেহারার পরিবর্তন | ফেসবুক
একটি মজার বিষয় হলো, এই পেইজটি প্রতিনিয়ত পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে কঠোর সমালোচনামূলক টেক্সট ও ভিডিও প্রকাশ করে গেলেও একদম শুরুতে ফলোয়ার জোগাড়ের জন্য যে প্রমোশনাল বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সেখানে পিনাকী ভট্টচার্য্য’র ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দেয়া হয়েছিল, “যারা পিনাকী দাদাকে ভালবাসেন, তারা ডান পাশে ফলো দিন।”
অর্থাৎ, পেইজটির এডমিনের পাঠককে বিভ্রান্ত করে তার ফলোয়ার বানানোর প্রচেষ্টা স্পষ্ট; যা একজন পেশাদার রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাজ হতে পারে না।