২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কলঙ্কিত এক দিন হিসেবে চিহ্নিত। সেদিন রাজধানীর পল্টন মসজিদের গলিতে লগি-বৈঠা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ অনার্স তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র হোসাইন মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামকে। একই তাণ্ডবে শাহাদাত বরণ করেন ঢাকা কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন।
রক্তাক্ত ২৮-এর সেই দিনের আরেক নামি শাহাদাতের মিছিলের শিকার ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র শহীদ আবদুল্লাহ আল ফয়সাল এবং শহীদ মু. রফিকুল ইসলাম। লগি-বৈঠার তাণ্ডবের শিকার হয়ে লাশের মিছিলে ছিলেন তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম। মুজাহিদ, শিপন, ফয়সাল, রফিক ও মাসুম সবার স্বপ্ন ছিল একটি স্বপ্নিল জীবন এবং একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার।
সেদিন কী ঘটেছিল?
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় তৎকালীন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী লগি-বৈঠার তাণ্ডব শুরু হয়। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াতের অফিস, নেতাকর্মীদের বাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে পৈশাচিক হামলা চালানো হয়। আগুন দেওয়া হয় সরকারি অফিস, বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনাকে, পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাণ্ডবলীলা।
সেদিন ২৮ অক্টোবর বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন ছিল। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের শপথ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট এই শপথ প্রতিরোধ করতে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। আওয়ামী লীগের ঘোষণা অনুযায়ী, যদি কে এম হাসান শপথ নেন, তবে অবরোধ চলবে।
সাতাশে অক্টোবর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতের খবর পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও গাজীপুরে চারজন নিহত হয়েছে বলে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের বাড়ি, অফিস ও গাড়িতে হামলার খবর প্রকাশিত হয়। ঢাকায় বিএনপির সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদের ডেমরার কার্যালয়ে আগুন, ধানমন্ডিতে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, খুলনায় বিএনপির দুই সংসদ সদস্য আলী আসগর লবী ও আব্দুল জলিল খান কালামের বাড়িতে হামলা চালানো হয়।
এমন আশঙ্কার মধ্যেই পল্টন ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে। ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র, গুলি এবং লগি-বৈঠা দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ছয় নেতাকর্মীকে পিটিয়ে মারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
ঘটনার পরদিন জামায়াতে ইসলামী পল্টন থানায় মামলা দায়ের করে, যেখানে ৪০ জনসহ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল ৪৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হয়। ২২ এপ্রিল মহানগর হাকিম মীর আলী রেজা চার্জশিট গ্রহণ করেন এবং একই দিনে আসামি শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরেরদিন ২৩ এপ্রিল মামলাটি স্থগিত করা হয় এবং তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিভিন্ন স্থান থেকে দায়ের করা মামলাগুলি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ৯ জুলাই ২০০৯ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আবু সাঈদ পল্টন থানায় হত্যা মামলার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন। ১৭ আগস্ট আদালত মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠা তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ড ছিল আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।