জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসনভিত্তিক একক প্রার্থী চূড়ান্ত করছে বিএনপি। দুই শতাধিক আসনের জন্য মনোনীত প্রার্থীদের শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগে নামার নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণার পর বিদ্রোহী প্রার্থী যেন না হয় সেজন্য দলের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হচ্ছে। এসব বৈঠকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক থেকে প্রার্থীদের নির্দেশনা দিয়ে বলা হচ্ছে- দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে সবার কাজ করতে হবে। যে মনোনয়ন পাবেন তাকেও বলা হচ্ছে, সবার মন জয় করে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, আসনে আসনে বিরোধ নিরসনে সিরিজ বৈঠকের পর চূড়ান্ত করা হবে একক প্রার্থী। ধানের শীষ প্রার্থীর পক্ষে না থাকলে নেমে আসবে বহিষ্কারের খড়গ। তিনি বলেন, সবাই যাতে একসঙ্গে কাজ করে সেই বিষয়টা নিশ্চিত করতে আমরা সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। যাতে একক প্রার্থী ঠিক করে তাকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া যায় মাঠে যাওয়ার জন্য, সেটা শুরু করেছি। এটা শিগগিরই আমরা বলে দিতে পারব। তাতে একক প্রার্থী হিসেবে মাঠে প্রার্থীরা গণসংযোগে যেতে পারবে।
বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ৩০০ আসনের মধ্যে কমপক্ষে শতাধিক আসনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একাধিক বিদ্রোহী দাঁড় করিয়ে মাঠে রাখতে চায় একটি বিশেষ মহল। বিদ্রোহী প্রার্থীদের পেছনে মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করবে। মহলটির টার্গেট এসব আসনে বিএনপির ভোট তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া। এমন ষড়যন্ত্রমূলক তথ্য বিএনপির হাইকমান্ড জানার পর মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে প্রার্থীদের নিয়ে যে বৈঠক হচ্ছে সেখানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নেতা-কর্মীরা বলছেন, নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ভোটের আবহ তৈরি হয়েছে। তাই, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। মনোনয়ন ঘিরে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। যারাই মাঠে দলের সুনাম নষ্ট করবে, আধিপত্য বিস্তার করবে, বিদ্রোহী হওয়ার মনোভাব দেখাবে তাদের বিরুদ্ধে বিএনপির হাইকমান্ড শক্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকদের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে এবার আগেভাগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে দলের হাইকমান্ড। গত রবিবার চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুর, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগের ১১৪টি সংসদীয় আসনের অন্তত সাড়ে তিন শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে দুই ধাপে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অক্টোবর মাস থেকেই এ বৈঠক চলছে।
বৈঠকগুলোতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘অভিভাবকসুলভ’ ভূমিকায় থাকলেও কঠোর বার্তা দিচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। বৈঠকের শুরুতেই দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা। তবে তারেক রহমান দেশ ও দলের বাস্তবতা তুলে ধরে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেন। তিনি আশ্বাস দেন, একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যারা চূড়ান্ত মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হবেন, তাদের নানাভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক সংসদ সদস্য এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত জানান, মনোনয়ন ঘিরে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বিএনপি এখন কঠোর অবস্থানে। যারাই মাঠে দলের সুনাম নষ্ট করবে, আধিপত্য দেখাবে বা বিদ্রোহী মনোভাব দেখাবে তাদের বিরুদ্ধে হাইকমান্ড শক্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। এই মুহূর্তে প্রার্থী বাছাই ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাই শীর্ষ নেতারা নিয়মিত মনোনয়নপ্রত্যাশীদের স্পষ্ট নির্দেশনা দিচ্ছেন। দল যাকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে, সবাই মিলে তার পক্ষে কাজ করতে হবে। কারণ দল মানেই ঐক্য, আর ঐক্যই আমাদের শক্তি।
ভোলা-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ডাকসুর সাবেক এজিএস ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজিমুদ্দিন আলম জানান, বৈঠকের মূল মেসেজ ছিল ঐক্য। আমাদের বলা হয়েছে, ১৮ বছর অনেক কষ্ট করেছেন। হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এক আসনে একাধিক প্রার্থী রয়েছে। সবাইকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। দল যাকেই মনোনয়ন দেবে তারপক্ষে কাজ করতে হবে। দলের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী হলে দলের অবস্থান কী হবে জানতে চাইলে বলেন, দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে এটা বলার উপেক্ষা রাখে না।
বরগুনা-২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মনিরুজ্জামান মনির সাক্ষাৎকার শেষে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বৈঠকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে সবাইকে ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। তিনি মনোনয়ন পাবেন তাকেও বলা হয়েছে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে সবার মন জয় করতে হবে। ১৮ বছর ধরে যারা নির্যাতিত ছিলেন সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ প্রার্থী হলে দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলেও জানানো হয়েছে।
বগুড়া-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন জানান, বৈঠকে ধানের শীষ প্রতীক যাকে দেওয়া হবে তার জন্য মাঠে থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ধানের শীষ প্রতীক যিনি পাবেন তাকেও বলা হয়েছে যারা আওয়ামী লীগের শাসনামলে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন সবার মন জয় করে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এদিকে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের আসন ছাড়ের বিষয়টিও দ্রুত সুরাহা করতে চায় বিএনপি। এ জন্য মিত্রদের কাছে তালিকা চেয়েছে দলটি। ভোটে জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী থাকলে সর্বোচ্চ ৫০টি আসনে ছাড় দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও এখনই তা জানাতে চান না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তাদের জন্য অর্ধশত আসন উন্মুক্ত রেখে সমঝোতার জন্য তফসিল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিএনপি।