Image description

বহু জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আগামী মাসে দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলীয় সূত্র ও ঘনিষ্ঠ পর্যায় থেকে জানা গেছে, তার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাংলাদেশে তার ফেরা শুধু বিএনপির রাজনীতিতেই নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সমীকরণেও নতুন অধ্যায় সূচনা করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘ ১৪ মাস পার হলেও তারেক রহমানের দেশে না ফেরা নিয়ে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মহলসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক কৌতুহল ছিল। তার ফিরে আসার পথে অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছিল তার নিরাপত্তার বিষয়টি। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঠেকাতে একটি পার্শ্ববর্তী দেশ মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ২৪ অক্টোবর গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘শিগগিরই জানতে পারবেন নির্ধারিত তারিখ। আশা করি, নভেম্বরের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরবেন।’ এই বক্তব্যের পর থেকেই বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ফিরে এসেছে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা—দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ হতে যাচ্ছে কি না, সেটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও নিরাপত্তাহীনতা
শুধু পার্শ্ববর্তী দেশের ষড়যন্ত্রই নয়, পতিত আওয়ামী লীগসহ দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলেও তথ্য রয়েছে। দলের শীর্ষনেতারা তাই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এ কারণেই পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিশ্চিতের আগে তার দেশে ফেরায় অধিকাংশ শীর্ষ নেতারই মত ছিল না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস বেশ পুরোনো এবং রক্তক্ষয়ী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া এক অস্থির রাজনৈতিক ভূখণ্ড, যেখানে জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ড বা হত্যাচেষ্টার ঘটনা বারবার ঘটেছে। ১৯৪৮ সালে ভারতে মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, পাকিস্তানে লিয়াকত আলী খান, বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড, ইমরান খানকে হত্যাচেষ্টা, নেপালে রাজা বীরেন্দ্র, শ্রীলঙ্কায় সলোমন বন্দরনায়েক, রণসিংহে প্রেমদাসা হত্যাকাণ্ড, আফগানিস্তানে মোহাম্মাদ দাউদ খান, নুর মোহাম্মদ তারাকি, মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ, বুরহানুদ্দিন রাব্বানি হত্যাকাণ্ড—এই তালিকা দীর্ঘ।

বাংলাদেশেও শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভুটান ও মালদ্বীপ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সব দেশই তাদের জাতীয় নেতাদের হারিয়েছে ঘাতকদের গুলিতে, নাহয় আত্মঘাতী বোমার আঘাতে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে নির্বাচন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সময়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক পরিস্থিতি ও সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘকাল ধরে ফ্যাসিবাদের রোশানলে থাকা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তারেক রহমান যে দৃঢ়তা ও সহনশীলতা দেখাচ্ছেন, তাতে আগামী দিনে দেশের জাতীয় নেতা হিসেবে তার আবির্ভূত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে আওয়ামী লীগসহ বিএনপি বিমুখ দলগুলো।

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একমাত্র বিকল্প’
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেতৃত্বের শূন্যতা একটি প্রকট বাস্তবতা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা  আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে পলাতক এবং তার দলও এক প্রকার নেতৃত্বশূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও দীর্ঘদিন যাবৎ শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা এই দলটি এখনো সাধারণ মানুষের কাছে সে রকম গ্রহণযোগ্যতায় পৌঁছেনি।

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন হওয়ার পর মানুষ যে আশার আলো দেখেছিল, গত ৮ মাসে তাদের নানা কর্মকাণ্ডে সেটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজটি করার মতো একমাত্র যোগ্য নেতা তারেক রহমান। তাই তিনি ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের নানা গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন।

বিশেষ করে, গত ৭ অক্টোবর বিবিসি বাংলায় সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে যখন তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুন্ন রেখে, এটি স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থ অটুট রেখে বাকি সবকিছু।’ এই বক্তব্য তারেক রহমানের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তুলে ধরে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার অঙ্গীকার প্রকাশ করে।

একই সাক্ষাৎকারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সম্পর্কে তারেক রহমান অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নেবো না।’ এই বক্তব্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশাকেই প্রতিফলিত করে, বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে তার দৃঢ় অবস্থান দেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিএনপির উদ্যোগে রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলায় একযোগে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও’ শিরোনামে মশাল প্রজ্বালন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারা দেশে এবং সামাজিক মাধ্যমে এই কর্মসূচি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বিএনপির এই কর্মসূচি নিশ্চিত দল হিসেবে বিএনপিকে জনমানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে।

নিরাপত্তা প্রস্তুতি: বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও অস্ত্রের আবেদন
তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনার অনুমতি দিয়েছে। একটি তার নিজ ব্যবহারের জন্য, অন্যটি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জুনে প্রথম বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমোদন দেওয়া হয়, আর এই অক্টোবরের শুরুতে আরেকটি গাড়ি কেনার অনুমতি মেলে। দলীয় সূত্র বলছে, জাপান থেকে গাড়ি আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে।

এছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতির জন্যও বিএনপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। এতে একটি শটগান ও দুটি পিস্তলের লাইসেন্স চাওয়া হয়েছে। যদিও এখনো অনুমোদন মেলেনি, তবে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত এসব উদ্যোগে সরকারের সহায়তাকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন দলীয় নেতারা।

ফেরার প্রতীক্ষায় গুলশানের বাড়ি
দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমান দেশে ফিরে গুলশানের ৭৯ ও ১৯৬ নম্বর দুটি বাসা মিলিয়ে থাকবেন। সেখানে ইতোমধ্যে সংস্কারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দলীয় নেতাদের মতে, তারেক রহমানের নিরাপত্তা ইস্যু এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও এ বিষয়ে যোগাযোগ হয়েছে এবং তাকে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তাও মিলেছে বলে জানিয়েছেন তারা।

বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে তার ট্রাভেল পাস ইস্যুসহ সব প্রশাসনিক প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (আইএলআর) স্ট্যাটাসে বসবাস করছেন। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ১/১১ সরকারের সময় চিকিৎসার জন্য স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জায়মা রহমানকে নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকেই সেখানেই অবস্থান করছেন।

তবে দূরত্ব কখনোই তাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি—লন্ডন থেকেই তিনি বিএনপির কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন এবং এখন প্রস্তুত হচ্ছেন দেশে ফিরে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপি যে নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছিল, দেশে ফিরে তার সরাসরি নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা নতুনভাবে গতি ফিরে পাবে। বিশেষ করে, দলের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে এবং তারা আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবে বলে মনে করছেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একদিকে যেমন দলের নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করবেন, তেমনি অন্যদিকে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার নেতৃত্ব অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠবে। তার এই প্রত্যাবর্তন কেবল বিএনপির নয়, সমগ্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, এই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে সরকারের প্রতিক্রিয়া, আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণ এবং দেশের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ- সবকিছুই আগামী দিনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।