Image description
 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সাভারের নিশান হাউজিংয়ের জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন বাবুলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেনের। হাউজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ ও জমির ব্যবসা নিয়ে এ বিরোধ দেখা দেয়। গত বুধবার (২২ অক্টোবর) বিকালে বিরোধ মীমাংসার কথা বলে সাভার মডেল থানার ওসি দুজনকে ডেকে নেন। সেখানে শুরু হয় বাবুলের সঙ্গে জাকিরের বাগবিতণ্ডা। শেষ পর্যন্ত বাবুলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বাবুলের চাচাতো ভাই আবু সাঈদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে বাবুলসহ সাত জনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, বুধবার রাত ৮টার দিকে বনগাঁ ইউনিয়নের বেড়াইদ গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হন আবু সাঈদ (৫২)। তিনি বেড়াইদ গ্রামের মৃত মুনতাজ আলীর ছেলে এবং পেশায় কৃষক ছিলেন। পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতি করতেন। এ ঘটনায় সাত জন আহত হন। তারা হলেন–বনগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবুল, তার অনুসারী জাবেদ, হিরু, সল্লিম উল্লাহ, আলিফ, আরাফাত ও নজুমদ্দিন। তাদের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, নিশান হাউজিংয়ের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জাকির ও বাবুল গ্রুপের বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জেরেই হামলার ঘটনা ঘটে। প্রভাবশালী জাকিরের পক্ষে কাজ করছে পুলিশ।

সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম রাজিবের ঘনিষ্ঠজন জাকির হোসেন। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে এলাকায় রয়েছে তার প্রভাব। বিগত কয়েক বছর ধরে নিশান হাউজিং নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা দুজনে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মঞ্জুরুল আলম পালিয়ে যান। আত্মগোপনে চলে যান জাকিরও। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে পরে সাভার থানা বিএনপির সভাপতি সাইফ উদ্দিন সাইফুলের সঙ্গে মিশে প্রকাশ্যে আসেন জাকির। এরপর বিএনপি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে নিশান হাউজিং নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন।

স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা জাকির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি নেতা সাইফুলের ঘনিষ্ঠজন হয়ে যান। সেইসঙ্গে শুরুতে কয়েক মাস বাবুলের সঙ্গে মিলে ব্যবসাও করেন। কয়েক মাস আগে হাউজিং ব্যবসার জমি নিয়ে বাবুলের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় জাকিরের। এ সময়ের মধ্যে উভয় পক্ষের কয়েক দফা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলা-মামলা হয়। এসব ঘটনার জেরে এলাকা ছাড়েন বাবুল। সম্প্রতি সাভার মডেল থানার ওসির আশ্বাসে এলাকায় ফেরেন।

savar-2গত বুধবার রাত ৮টার দিকে বনগাঁ ইউনিয়নের বেড়াইদ গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বাবুল এলাকায় আসার পর গত বুধবার বিকালে বিরোধ মীমাংসার কথা বলে বিবাদমান হাউজিং এলাকায় ডেকে নিয়ে যান সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জুয়েল মিয়া। সেখানে গিয়ে বাবুল দেখেন জাকিরের সঙ্গে বসে আছেন ওসি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জাকিরের আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা ও মামলার বিষয় তুলে ধরে ব্যবস্থা নিতে বলেন বাবুল। এ নিয়ে শুরু হয় দুজনের বাগবিতণ্ডা। এ অবস্থা দেখে সন্ধ্যার দিকে ওসি সেখান থেকে চলে যান। 

স্থানীয় দুজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ওসি চলে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পর বেড়াইদ এলাকায় বাবুলকে একা পেয়ে হামলা চালান জাকির ও তার অন্তত ৩০-৪০ জন সহযোগী। হামলার ঘটনা দেখে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তার চাচাতো ভাই আবু সাঈদ বাঁচাতে এগিয়ে গেলে তার ওপরও হামলা করা হয়। এ সময় ইটপাটকেল ছুড়ে ও পিটিয়ে এবং কুপিয়ে তাদের জখম করা হয়। এতে দুজনই অচেতন হয়ে পড়েন। সে অবস্থায়ও পেটানো হয়। তাদের উদ্ধারে এগিয়ে গিয়ে হামলায় আহত হন আরও ছয় জন। পরে তাদের উদ্ধার করে এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে সাঈদকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। 

এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রাকিব আল মাহমুদ শুভ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘সাঈদকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। এ ছাড়া আহতদের মধ্যে বাবুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।’

ঘটনাস্থলে যা দেখা গেলো

২৩ অক্টোবর বিকালে সরেজমিনে ওই এলাকায় দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের পর থেকে গোটা এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যে স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা ইটের টুকরো। স্থানীয়রা বলছেন, এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রাইম সিন সংরক্ষণ করা হয়নি।

বনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ত্রিমুখী মোড়জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইটপাটকেল ও ভাঙাচোরা লাঠিসোঁটা। দেখেই বোঝা যায়, এখানে মারামারির ঘটনা ঘটেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় দুজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, বনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় জাকিরের অর্থায়নে পরিচালিত নিশান হাউজিংয়ের চারটি কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয় থেকেই ওই দিন হামলায় ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র বের করা হয়। ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে এসে প্রাণ হারান আবু সাঈদ। হামলার পর সাঈদের লাশের ওপরও চলেছিল হিংস্রতা। হামলার আগে এলাকায় পুলিশ এলেও হামলা চলাকালীন কিংবা পরে আসেনি। আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর পর এসেছিল পুলিশ।

পরিবারের অভিযোগের তির পুলিশের দিকে 

এ ঘটনায় পুলিশকে অভিযুক্ত করছেন নিহত ও আহতের স্বজনরা। তাদের দাবি, বিরোধ মীমাংসার নামে ডেকে তাদের ওপর হামলার সুযোগ করে দিয়েছে পুলিশ। এমনকি হামলা নিয়ন্ত্রণে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি তারা।

নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই আবু বকর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাকির ৩৫-৪০ জন ভাড়াটিয়া গুন্ডা পালেন। তাদের রাখেন নিশান হাউজিংয়ের বিভিন্ন কার্যালয়ে। তারা এলাকার লোকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন, জমির ব্যবসা করেন। মূলত এসব নিয়েই জাকির ও বাবুলের দ্বন্দ্ব। তাদের এই বিরোধ মীমাংসা করে দেবেন বলে ওই দিন বিকালে বাবুলকে ডেকে নিয়ে যান সাভার মডেল থানার ওসি জুয়েল মিয়া।’

আবু বকর আরও বলেন, ‘বাবুল গত কয়েক মাস ধরে এলাকার বাইরে ছিল। ওসি নিজে বাড়ি এসে বাবুল কই আছে, ডেকে আনতে বলেছিল। বাবুলের সঙ্গে ফোনে ওসি বলেছিল, “তুমি এলাকায় আসো, কথা কমু, তারপর একটা ব্যবস্থা নিমু। তোমার আর এলাকার বাইরে থাকা লাগবো না।” এভাবে এলাকায় ডেকে এনে জাকির ও তার ভাড়াটিয়া গুন্ডাদের হাতে বাবুলকে তুলে দিয়েছে ওসি। আমরা এখন বুঝতে পারছি, ওসি জাকিরের টাকা খেয়ে সেদিন বিরোধ মীমাংসা করে দেবে বলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। পরে হামলা হয়।’  

তিনি বলেন, ‘আমার ভাই যখন দৌড়ে পালাইতে গিয়েছিল তখন ৩০-৩৫ জন একসঙ্গে পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থল থেকে ওসি যাওয়ার মাত্র ২০ মিনিট পর। এতেই বোঝা যায়, ওসি নিজেও এর সঙ্গে জড়িত। কারণ ওই দিন ওসির গাড়িতে করে হাউজিংয়ের ভেতরে যায় জাকির। আবার ওই গাড়িতে করেই হাউজিং থেকে বের হয়। এতে কী বোঝা যায়। ওসি নিজেও এসব সন্ত্রাসী পালে। জাকির একাধিক মামলার আসামি। অথচ তাকে ধরে না পুলিশ। এমনকি সাঈদ হত্যাকাণ্ডের পরও জাকির এলাকায়। তবু গ্রেফতার করেনি পুলিশ।’ 

savar-3স্থানীয় বিএনপির কার্যালয়

আহত বাবুলের স্ত্রী আফরোজা আক্তার বৃষ্টি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামী এতদিন এলাকায় ছিল না। জাকিরের কারণে থাকতে পারতো না। ওসির আশ্বাসে বুধবার সকালে এলাকায় এসেছিল। এরপর ওসি ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। পরে জাকির ও তার লোকজন পিটিয়ে আহত করে। হামলায় আমার দেবর মারা যায়। স্বামী মৃত্যুশয্যায়। ঘটনার পরেও ওসিরে জাকির টাকা দিয়েছে। এজন্য এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে যা বলছে পুলিশ

দুজনের বিরোধ মীমাংসার আশ্বাস, ঘটনার দিন জাকিরকে গাড়িতে করে সঙ্গে নিয়ে নিশান হাউজিংয়ে যাওয়া-আসা ও হামলার পূর্বাপর বিষয়ে জানতে চাইলে সাভার মডেল থানার ওসি মো. জুয়েল মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। এসব অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই। আমি সেদিন ওই এলাকায় গিয়েছিলাম, এটা সত্য। সাভার পুরো থানা এলাকার যেকোনো স্থানেই আমি যেকোনো কাজে যেতেই পারি। কিন্তু তাদের বিরোধ মীমাংসা করতে গিয়েছি, এ কথা সঠিক নয়। আমি গিয়েছিলাম বিকালে। হামলার ঘটনা ঘটেছে রাতে। শুধু আমি না, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারও গিয়েছিলেন।’

তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল উল্লেখ করে ওসি মো. জুয়েল মিয়া আরও বলেন, ‘সেগুলো নিয়ে এর আগেও হামলা-মামলা হামলা হয়েছে। জাকিরের বিরুদ্ধেও আগে মামলা হয়েছে। সেই মামলা আমরা গ্রহণ করেছি, আসামি গ্রেফতারও করেছি।’ 

নিশান হাউজিংয়ের ভেতরে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে ওসি বলেন, ‘মূলত ওই হাউজিংয়ে কার প্লটের অবস্থান কোথায়, জায়গার পরিমাণ কত, কোথায় কে বালু ফেলতেছে, কোথায় বালু ফেলবে, এসব দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে যাই।’

জাকিরের সঙ্গে বাবুলের বিরোধ মীমাংসার আশ্বাস ওসির এবং নিশান হাউজিংয়ে যাতায়াতের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম আ্যান্ড অপস) মো. আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘ওসি তো নিরাপত্তার জন্য যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় যেতে পারেন। এলাকায় যখন উত্তেজনা থাকে, তিনি যেতে পারেন। ওই ঘটনায় মামলা করেছেন বাদী, তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’

জাকিরের বিরুদ্ধে আগের মামলার বিষয়ে কোনও তথ্য আমার কাছে নেই উল্লেখ করে আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘ওই দিন রাতে ঘটনাটি ঘটেছে। তদন্ত করছি আমরা। পরে বিস্তারিত জানাতে পারবো।’ কী নিয়ে হামলা হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিকালে তেমন কিছু হয়নি। রাতে কী নিয়ে হামলা হয়েছিল তা আমার জানা নেই।’

মামলা ও গ্রেফতার

সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার সাভার মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ আনোয়ার নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। আনোয়ার জাকিরের পক্ষের লোক। ওসি জুয়েল মিয়া বলেন, ‘মামলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

সাঈদকে হত্যার পর লাশের ওপর নৃশংসতা

ওই দিন সন্ধ্যায় বেড়াইদ বাজারে এসেছিলেন আবু সাঈদ। সেখানেই চাচাতো ভাই বাবুলের ওপর জাকিরদের হামলা হয়। দেখে ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে ইটপাটকেল, দেশীয় অস্ত্র দিয়ে সাঈদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর তার লাশের ওপর চলে নৃশংসতা। 

প্রত্যক্ষদর্শী বেড়াইদ এলাকার বাসিন্দা জুনায়েদ হোসেন ও রবিউল ইসলাম জানান, পিটিয়ে হত্যার পর লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নৃশংসতা চালানো হয়। পা দিয়ে মাড়াতে থাকে হামলাকারীরা। জাকিরের সঙ্গে হামলায় অংশ নেওয়া আশহাবুল, তার ছেলে ইয়ামিন ও কালাম লাশ পদদলিত করে। উদ্ধারে এগিয়ে গেলে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হাত ভেঙে যায় জুনায়েদের। তিনি বলেন, ‘ওরা সাঈদের শরীরের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে হিংস্র আচরণ করেছিল। তা দেখে এগিয়ে গেলে আমার ওপর হামলা করে। লাশের ওপর নৃত্য করেছিল তারা।’