Image description

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করতে কর্মজীবীদের বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন ও সমিতির প্রতিনিধিদের মতবিনিময় সভা করছে পে কমিশন। গত সপ্তাহে এমন দেড় শতাধিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশনের সদস্যরা। যাদের অধিকাংশই সর্বনিম্ন বেতন ৩০ হাজার টাকার বেশি করতে প্রস্তাবনা দিয়েছে। ২০২৬ সালের শুরুতেই নতুন পে স্কেল ঘোষণার লক্ষ্যে কমিশন দ্রুতগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার পে কমিশন গঠন করার পর গেল ১৪ আগস্ট প্রথম বৈঠকে বসেন কমিশনের সদস্যরা। পরে ১-১৫ অক্টোবর অনলাইনে চার ক্যাটাগরিতে সাধারণ নাগরিক, চাকুরীজীবী, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও অ্যাসোসিয়েশন ও সমিতির মতামত নেয়া হয়। গত সোমবার (২০ অক্টোবর) থেকে সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে কমিশন। যদিও ১৬ অক্টোবর থেকে এই মতবিনিময় শুরু হওয়ার কথা ছিল।

এসব সভায় নিজেদের পক্ষে বেতন কাঠামো প্রস্তাব এবং তার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা।  কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, সরকারি রাজস্ব ও উৎপাদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে এবার বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হবে।

এখন পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি সংগঠন কমিশনের কাছে নিজেদের মতামত দিয়েছে। অধিকাংশ প্রস্তাবেই সরকারি চাকরিজীবীদের বর্তমান বেতন কাঠামোকে ‘অপ্রতুল ও সময়োচিত নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সব সংগঠনই বেতনের অনুপাত কমিয়ে ১:৪ করার দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি গ্রেড কমিয়ে বৈষম্য নিরসনের প্রস্তাব করেছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, কর্মচারী সমিতি এবং কারিগরি কর্মচারী সমিতি তিন সংগঠন ৪০ হাজার টাকা, সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ ৩৬ হাজার টাকা, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিডিপিএ), মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন ৩৫ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মূল বেতন করার প্রস্তাব করেছে। তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি সর্বনিম্ন বেতনের প্রস্তাব করেছে ২৫ হাজার টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের চলমান রাজস্ব পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণ-সহায়তা বিষয়গুলো বিবেচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষা করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে আশা করছেন কর্মজীবীরা। তবে সরকারের সক্ষমতা বিবেচনা করেই আসবে সুপারিশ।

 

কমিশনে আসলো যেসব প্রস্তাব

কমিশনের জমা পড়া প্রস্তাবনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন মূল বেতন বৃদ্ধি অন্যতম। কয়েক ডজন প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ সংগঠনই সর্বনিম্ন বেতন ৩০ হাজারের বেশি প্রস্তাব করেছে। যৌক্তিকতা হিসেবে তারা বিভিন্ন যুক্তিও তুলে ধরেছে।

১১–২০ গ্রেড সরকারি চাকরিজীবী ফোরাম বলেছে, একজন নিম্ন গ্রেডভুক্ত কর্মচারীর পরিবারে গড়ে ছয়জন সদস্য থাকে। বর্তমান বাজারদরের প্রেক্ষিতে প্রতিজনের দৈনিক খাদ্য ব্যয় ১৭৫ টাকা হিসেবে হিসেব করলে, একটি পরিবারের মাসিক খাদ্য ও পথ্য ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। তাই সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩২ হাজার করতে হবে। বাংলাদেশ তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি বলেছে, ছয়জনের খাবার ৪ হাজার টাকা করে ধরলেও মাসে ২৪ হাজার টাকা শুধুমাত্র খাবার খরচ হয়। এছাড়া অন্যান্য খরচ মিলিয়ে অনেক টাকার প্রয়োজন। সে বিবেচনায় অন্তত ৩০ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মূল বেতন করতে হবে।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন, কর্মচারী সমিতি এবং কারিগরি কর্মচারী সমিতি তিন সংগঠন ৪০ হাজার টাকা, সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদ ৩৬ হাজার টাকা, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিডিপিএ), মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন ৩৫ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মূল বেতন করার প্রস্তাব করেছে। তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি সর্বনিম্ন বেতনের প্রস্তাব করেছে ২৫ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুল আলম বলেন, প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে আমরা দুইটি বিষয় মাথায় রেখেছি। প্রথমত নিচের গ্রেডের একজন কর্মচারীর ছয়জনের সদস্য নিয়ে জীবন চালাতে মিনিমাম একটা চাহিদা আছে। এক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা মূল বেতন হলে অন্যান্য ভাতা দিয়ে তার সর্বমোট বেতন ৪০ হাজার টাকা ছুঁয়ে যায়। তাই এটা সর্বনিম্ন বেতন হতে পারে।

সরকারের সক্ষমতা বিবেচনা করে ওই প্রস্তাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যেহেতু অর্থ বিভাগে কর্মরত তাই আমরা অনুধাবন করি, শুধুমাত্র প্রস্তাব দিলেই হবে না, সরকারের সক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া সর্বনিম্ন গ্রেডের কর্মচারীর মূল বেতন ৩০ হাজারের বেশি করলে তার প্রভাব বাজারে পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি চাকরিজীবী ও অন্যান্য কর্মজীবীরা বেকায়দায় পড়বেন। সবকিছু বিবেচনা করেই এই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

তবে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৩৫ হাজার টাকা করা না হলে আন্দোলনের হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন অন্য সংগঠনগুলোর নেতারা। বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারি সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবির বলেন, কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র গাড়ি খরচই ৫০ হাজার টাকা, তাহলে কর্মচারীদের বেতন কেন ৩৫ হাজার করা হবে না? এছাড়া পে কমিশনের এই স্কেল কমপক্ষে আগামী পাঁচ বছর চলবে, সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। আর এসব বিষয় যদি বিবেচনা না করা হয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা হবে।

ন্যূনতম মূল বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি সব সংগঠনই গ্রেড সংখ্যা কমানোর প্রস্তাব করেছে। এক্ষেত্রে ১:৪ অনুপাত রেখে ১০ থেকে ১২টি গ্রেড করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা ভাতা বাড়িয়ে ৫ থেকে ১০ হাজার, ইনক্রিমেন্টের হার বাড়িয়ে ৭-১০ শতাংশ করা এবং টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো।

বাস্তবতা কী?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটই নতুন পে স্কেল প্রণয়ন বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি গড় ৯ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে, সরকারি রাজস্ব আদায় আগের বছরের তুলনায় প্রায় বাড়লেও ব্যয়ের চাপও বাড়ছে বহুগুণে।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, আমরা নিচের দিকের গ্রেডের মূল বেতন একটু বেশি বৃদ্ধি করতে আন্তরিক, তবে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও দেখতে হবে। দুইদিক বিবেচনা করে সরকারি কর্মজীবীদের আশা পূরণে কাজ চলছে। খুব দ্রুত এর ফলাফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।   

নতুন পে স্কেল ঘোষণা আসছে কখন?

কমিশন সূত্র বলছে, ২০২৫  সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হতে পারে। এরপর অর্থ বিভাগ ও মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সুপারিশ যাচাই-বাছাই করে গেজেট আকারে প্রকাশ করবে। কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, কমিশনের কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে তারা খুব আন্তরিক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই হয়ত নতুন বেতন কাঠামোর জন্য সুপারিশ করতে পারবেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে কমিশনের অন্তত তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। তারা সবাই একই টাইম ফ্রেমের আভাস দিয়েছেন। যদিও কমিশনের মেয়াদ আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, তবে কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যেই সুপারিশের লক্ষ্যে কাজ করছে। কমিশনের সদস্যরা বলছেন, সমিতি/অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মতবিনিময় শেষ হতে অক্টোবর মাস লেগে যাবে। এরপর কমিশন চূড়ান্ত সুপারিশের জন্য খসড়া তৈরি করবে এবং সেটা পর্যালোচনা করে সুপারিশ জমা দেবে।

সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী সরকারের জন্য অপেক্ষা না করে, সুপারিশ পেলেই দ্রুত নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করা হবে।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নেতারা বলছেন, “সব চাকরিজীবী এখন ২০১৫ সালের কাঠামোতে বেতন পাচ্ছেন। পণ্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি হয়েছে, তাতে বর্তমান বেতন টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমরা আশা করছি কমিশন এমন একটি প্রস্তাব দেবে, যা শুধু বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং মর্যাদা ও ন্যায্যতার প্রতিফলন ঘটাবে এবং বৈষম্য নিরসন হবে।”