Image description

জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার আইনি বাধ্যবাধকতায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ ছোট দলগুলো। এসব দল মনে করছে, এই সিদ্ধান্তটি তড়িঘড়ি নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্র কিংবা বহুমতের সংসদীয় গণতন্ত্র অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হবে। ছোট দলগুলো বড় দলের সঙ্গে পেরে উঠবে না। সংসদেও বহুমতের আদর্শ প্রতিফলিত হবে না, যা গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে না। 

ছোট দলগুলোর মতো বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিও জোটগত নির্বাচনে প্রতীকে নির্বাচনী আইনি বাধ্যবাধকতায় নাখোশ। দলটি বলেছে, এতে তাদের সম্মতি নেই। শিগগিরই তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনে এবং আইন উপদেষ্টার কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। এমন বিধান নিয়ে দ্বিমত নেই জামায়াতে ইসলামীর। জোটভুক্ত হলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

‘কোনো দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও নিজেদের প্রতীকে অংশ নিতে হবে’– এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। 

নিবন্ধিত দলগুলোকে নিজ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের এই আইনি জটিলতায় বিপাকে পড়েছে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দলের নেতারা জানান, বিগত দিনে এ রকম কোনো বিধিবিধান ছিল না। জোটবদ্ধ নির্বাচনে তারা জোটের যে কোনো প্রতীকে নির্বাচন করতে পারতেন। কিন্তু হঠাৎ করে আরপিওর এমন সংশোধনীতে নির্বাচনে বেশ প্রভাব পড়বে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অল্প সময়ে এসব দলের প্রতীককে জনগণের সামনে পরিচিত করা, তাদের কাছে জোটের বার্তা দেওয়া অনেক কঠিন এবং কষ্টসাধ্য হবে। আগে যেমন একটি বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করলে এক ধরনের বার্তা দেওয়া যেত, জোটগত প্রার্থী হিসেবে কম সময়ে পরিচিতি পেত, এখন সেটা অনেকটা দুরূহ হবে। 

নেতারা অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন ও সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে, তাদের সম্মতি না নিয়েই এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিগত দিনে নির্বাচন-সংক্রান্ত সংস্কার বিষয়ে আলোচনায় এ বিষয়টি উত্থাপিত হলেও তারা আপত্তি জানিয়েছিলেন। তখন তাদের বলা হয়েছিল, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু সেসব না করেই হঠাৎ করে এ রকম আইন করেছে সরকার। এটা পুনরায় বিবেচনা করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তারা চিঠি দেবেন বলেও অনেক নেতা জানিয়েছেন। 

বিগত দিনে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ সমকালকে বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন এটা কাদের চাপে, কী জন্য করেছে, সেটা সরকারকেই বলতে হবে। এ রকম কাজ তো শেখ হাসিনা করতেন। জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক উন্মুক্ত থাকা দরকার। দলীয় সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন বলেও জানান তিনি। 

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আগে জোটগত নির্বাচনে যে কোনো প্রতীকে নির্বাচন করা যেত। এখন যেটা হয়েছে তাতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, অনেক সময় ব্যয় করতে হবে।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বহুমতের গণতন্ত্র এবং সংসদে বহু দলের অংশগ্রহণ অনেকটাই ব্যাহত হবে। আগে ছোট দলগুলো যে সুবিধা পেত, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রতীকের বিষয়টা উন্মুক্ত থাকাটাই উচিত ছিল। এটাই ভালো হতো। 

এসব দলের নেতারা এটাও বিশ্বাস করেন– নির্বাচন কমিশনের এই আইন অবশ্যই ভালো। এতে প্রতিটি দলের পরিচিতি যেমন বাড়বে, তেমনি এসব দলের অবস্থানও সুসংহত হবে। আবার বড় দলগুলোর ভিড়ে এসব দল হারিয়ে যাবে না। কিন্তু এবারের নির্বাচনে এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে বলেও আশঙ্কা করছেন তারা। 

তারা বলছেন, বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাই ধ্বংস করে ফেলছিল আওয়ামী লীগ। সেসব নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলেরই অস্তিত্ব ছিল না। যেহেতু দেশে কোনো নির্বাচন ছিল না, রাজনীতি ছিল না– সেহেতু এসব দলের পরিচিতি, তাদের দলীয় কাঠামো, দলীয় প্রতীক নিয়ে মাঠে কাজও করতে পারেনি। ফলে জনগণের কাছে তাদের অনেককিছু এখনও অনেকটাই অপরিচিত। আগামী নির্বাচনের আগে এই স্বল্প সময়ে সেসব উত্তরণ করাটা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই এই নির্বাচনে এ বিষয়ে ছাড় দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে কার্যকর করলে ভালো হবে বলে নেতারা মতামত দেন। 

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমদ বলেন, এই আইনে অনেক ছোট দল ঝামেলায় পড়বে। এই আইন ভালো হয়েছে। প্রত্যেক দলের নিজস্বতা প্রকাশ পাবে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সারাদেশে ভোটের অনুপাত এবং উচ্চকক্ষ সংসদের সুবিধাও পাওয়া যাবে। 

এদিকে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনে যেমন যোগ্য প্রার্থী গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রতীকও একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে জনপ্রিয় প্রতীককে খুঁজে এবং পছন্দ করে। কিন্তু যদি সেটা না হয় তাহলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রতীকেই ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। আগামী নির্বাচনে বিগত দিনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে যুগপতে থাকা দলগুলো নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেখানে এসব দলকে পঞ্চাশটির কমবেশি আসন ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনাও করছে দলটি। কিন্তু বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ ব্যতীত ওইসব দলের নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করলে অনেক ক্ষেত্রেই ভরাডুবি ঘটতে পারে, অনেক আসন হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, ওইসব প্রতীক সাধারণ ভোটারের কাছে অপরিচিত। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল শুক্রবার সংবাদমাধ্যমকে জানান, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অনেকগুলোতে আমরা সবাই সম্মত হয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচনী আচরণবিধি ও আরপিওর যে খসড়া উত্থাপন করা হয়েছে, এটাতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে বিএনপির কোনো সম্মতি ছিল না।

তিনি বলেন, অধ্যাদেশের জন্য যেসব সংশোধনী এসেছে, তার অধিকাংশের সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু প্রতীকের (নিজস্ব প্রতীকের বাইরে জোটের প্রতীক নিতে পারবে না) এ বিষয়ে আমরা সম্মত হইনি। আমাদের একটা সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে, নির্বাচনের স্বার্থে এটা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনে এবং আইন উপদেষ্টার কাছে এ কথা আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে জানিয়েছি, আমরা হয়তো আনুষ্ঠানিক চিঠিও দেব।