ন্যাশনাল ব্যাংকের দুর্দশা যেন কাটছেই না। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অব্যাহত লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মোটা অংকের তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের এই ব্যাংকটি। খবর নিয়ে জানা গেছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের সব সূচকেই অবনতি অব্যাহত রয়েছে। অস্বাভাবিক হারে কমেছে আমানত। বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এর বিপরীতে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিও বেড়েছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে সিকদার পরিবারের হাতে জিম্মি ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা পালানোর পর ব্যাংকটির দায়িত্ব নেন ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। তবে তার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যাংকটির আর্থিক সূচকে কোন উন্নতি হয়নি। বরং বিভিন্ন সূচকে অবনতি হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকের মোট দায়ের ১৭ শতাংশ তারল্য হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি এতটাই অবনতি হয়েছে যে, বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ কারণে নিয়মিত জরিমানা গুণতে হচ্ছে ব্যাংকটির।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া ধারের টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে নিট সুদ আয় নেতিবাচক হওয়ায় বড় লোকসানে পড়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
আবদুল আউয়াল মিন্টু ন্যাশনাল ব্যাংকের দায়িত্ব নেন ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট। ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে প্রতিষ্ঠানটির আমানতের স্থিতি ছিল ৩৭ হাজার ছয়’শ ৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন মাসের শেষ তা হ্রাস পেয়ে ৩২ হাজার ছয়’শ ১০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গত ৯ মাসে ব্যাংকটি নিট আমানত হারিয়েছে পাঁচ হাজার ২০ কোটি টাকা।
এদিকে ধারের টাকা শোধেও ব্যর্থ ন্যাশনাল ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর তারল্য সংকট দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৬ হাজার কোটি টাকা ধার দেয়। আবার অন্য ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি দিয়ে আরও ৯’শ ৮৫ কোটি টাকা ধার নিয়ে দেওয়া হয়। ধারের টাকা পরিশোধ করার মেয়াদ কয়েকবার শেষ হলেও ন্যাশনাল ব্যাংক শোধ করতে পারেনি। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে কয়েক ধাপ সময়ও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে, চলতি হিসাবে ঘাটতি রেখে লেনদেন করার সুযোগ দেওয়া হয়, যার পরিমাণ ২ হাজার ৩’শ ৭০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বমোট ৯ হাজার ৩’শ ৫৫ কোটি টাকা ধার দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোটা অংকের তারল্য সহায়তা সত্ত্বেও গ্রাহকের আমানতের টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। টাকা না পাওয়ায় সংসারের দৈনন্দিন কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহকদের। চিকিৎসা ব্যয়, সন্তানের স্কুলের বেতন-ভাতা প্রদান নিয়ে গ্রাহকরা বিপাকে আছেন। অনেক দেন-দরবারের পর একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারছেন। আমানতের টাকা না পেয়ে গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
এদিকে, ন্যাশনাল ব্যাংকে হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তথ্য অনুযায়ী, গেল ৯ মাসে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাংকটির। চলতি বছরের জুন মাস শেষে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ১’শ ৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৭’শ ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৭’শ ২২ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই নয় মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৮’শ ৬৭ কোটি টাকা।
এদিকে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ থেকে নগদ আদায়ের পরিস্থিতিও খারাপ। গত ৯ মাসে মাত্র ২শ’ ৪১ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সিকদার পরিবার নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকটিকে রসাতলে নিয়ে গেছে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ট বড় কিছু ব্যবসায়ী বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া, সুদ মওকুফ করানো ও টাকা পাচারের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংককে বেছে নিয়েছিলেন। সূত্র বলছে, ব্যাংকটির বড় অংকের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ায় তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে বড় অংকের। ব্যাংকখাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় অংকের ঋণ খেলাপির কারণে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে, এর ফলে মূলধন ঘাটতিও বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার ৮’শ ৫৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন মাস শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। এই ৯ মাসে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৫ হাজার ৬’শ ৪৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। গত ৯ মাসে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
আমানতের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা রাখতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। নিয়ম অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের চার শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে হয়। আর সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ রাখতে হয় ১৩ শতাংশ। ব্যাংকগুলো এসএলআরের উদ্ধৃত্ত সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে ধার নেয়। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্ধৃত্ত সিকিউরিটিজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এরপর এসএলআর সংরক্ষণের সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখেও ধার করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের অব্যাহতভাবে এসএলআর ঘাটতি রয়েছে। সেই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১০ কোটি টাকায়। অপরদিকে সিআরআর ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২শ’ ৫২ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল ব্যাংকের এই দূরবস্থার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ কি? জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান শীর্ষনিউজ ডটকমকে বলেন, ব্যাংকটিকে কীভাবে ভালো করা যায় সেই চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির ফরেনসিক অডিট শুরু হচ্ছে। অডিট রিপোর্ট হাতে পেলে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে যেহেতু কয়েকটি ব্যাংক মার্জার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর সফলতা কতটুকু- তা দেখে বাকি ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের সুদ আয়ও নিম্নমুখী, ফলে বড় অংকের লোকসান গুণতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ৯ মাসে নিট সুদ আয় ঋণাত্মক দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮শ’ ৩৩ কোটি টাকা।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকের ৯৯১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৬৫২ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের পুরো সময় ব্যাংকের লোকসান হয়েছিল ১ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
শীর্ষনিউজ